আজকের আলোচনার বিষয় হলো ধাতুনির্মিত পদার্থ কাটার জন্য হ্যাক-স (Hacksaw) এর ব্যবহার। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই পাঠে আমরা জানব কিভাবে বিভিন্ন ধাতব উপকরণ সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে কাটার জন্য হ্যাক-স ব্যবহৃত হয়।
হ্যাক-স হল একটি বহুল পরিচিত ও সহজে ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার, যা ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেরামতের কাজে অপরিহার্য। ধাতব পদার্থ কাটার ক্ষেত্রে এর সঠিক ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেকোনো প্রকৌশলীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চলুন, বিস্তারিতভাবে হ্যাক-স এর বিভিন্ন ব্যবহার, ধরন ও ব্যবহারবিধি নিয়ে আলোচনা শুরু করি।
ধাতুনির্মিত পদার্থ কাটার জন্য হ্যাক-স এর ব্যবহার
হ্যাকস (Hack-Saw)
হ্যাক-স হলো ধাতুনির্মিত পদার্থ কর্তনের জন্য ব্যবহৃত একটি প্রধান হাতিয়ার। এটি সাধারণত দুটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত — একটি ফ্রেম এবং একটি ব্লেড।
হ্যাক-সের ফ্রেম
ফ্রেম দুই প্রকারের হয়ে থাকে:
সমন্বয়যোগ্য ফ্রেম (Adjustable Frame):
এই ফ্রেমের আকার প্রয়োজন অনুসারে ছোট বা বড় করা যায়। ফলে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ব্লেড ব্যবহার করা সম্ভব হয়।স্থির ফ্রেম (Fixed Frame):
এই ফ্রেমের আকার পরিবর্তনযোগ্য নয় এবং এতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট মাপের ব্লেডই ব্যবহার করা যায়।
দ্রষ্টব্য: স্থির ফ্রেমের একটি উদাহরণ ১.৭৪ নম্বর চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।
হ্যাক—স ব্লেড (Hack-Saw Blade) :
হ্যাক-স ব্লেড সাধারণত টাংস্টেন স্টিল অথবা হাই স্পিড স্টিল দিয়ে তৈরি হয় এবং এতে টেম্পারিং (Temper) প্রক্রিয়া করা থাকে, যার ফলে ব্লেড শক্তিশালী এবং টেকসই হয়।
ব্লেডের দৈর্ঘ্য: ব্লেডের দুই প্রান্তে থাকা ছিদ্রের দূরত্বকে ব্লেডের দৈর্ঘ্য বলা হয়।
সাধারণ দৈর্ঘ্য: ২৫০ মিমি থেকে ৩০০ মিমি (প্রায় ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি)।
প্রস্থ: ১২ মিমি থেকে ১৬ মিমি।
বেধ: ৬৩ মিমি অথবা ৮০ মিমি।
বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ কাটার জন্য ব্লেডের দাঁতের পিচ (দাঁতের ঘনত্ব) বিভিন্ন রকম হতে পারে। নিচে ছকে বিভিন্ন ধাতুর জন্য উপযুক্ত দাঁতের পিচ ও দাঁতের সংখ্যা প্রদর্শিত হলো:
ধাতুর নাম | দাঁতের পিচ (মিমি) | দাঁতের সংখ্যা (প্রতি ইঞ্চি) |
মাইল্ড স্টীল, কাস্ট আয়রণ | ১.৮ | ১৪ |
টুল স্টীল, হাই কার্বন স্টীল, হাই স্পিড স্টীল | ১.৪ | ১৮ |
অ্যাঙ্গেল আয়রণ, ব্রাস, কপার, রড আয়রণ, পাইপ | ১.০ | ২৮ |
কছুহট, পাতলা পাইপ, পাতলা শীট ইত্যাদি | ০.৮ | ৩২ |
ব্লেড ও ফ্রেম সংযোজন ও ব্যবহার পদ্ধতি
বিভিন্ন পিচের ব্লেড ফ্রেমে সঠিকভাবে লাগানোর নিয়ম ১.৭৭ নম্বর চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।
হ্যাক–স চালানোর সময় শরীরের অবস্থান ও ফ্রেমের ধরন কেমন হওয়া উচিত তা ১.৭৮ নম্বর চিত্রে দেখানো হয়েছে।
ধাতু কর্তনের সময় হ্যাক–স ধরার ভঙ্গি ও ব্যবহারের নিয়ম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। বিভিন্ন ধরণের কাটার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরন ১.৭৯, ১.৮০ ও ১.৮১ নম্বর চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে।
ব্লেড ভেঙ্গে যাওয়ার প্রধান প্রধান কারণ নিম্নে বর্ণিত হলো :
করাতের ব্লেড ভেঙ্গে যাওয়া একটি সাধারণ কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সমস্যা, যা কাজের গতি ও ফলাফলকে প্রভাবিত করে। ব্লেড দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর রাখতে নিম্নলিখিত কারণগুলো এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
১. ফ্রেমের সাথে ব্লেড ঢিলাভাবে লাগানো:
ব্লেড ঠিকমতো আঁটানো না থাকলে কাটার সময় অতিরিক্ত দোলনের সৃষ্টি হয়, যা ব্লেড ভেঙে যাওয়ার কারণ হয়।
২. ফ্রেমের সাথে ব্লেড অত্যধিক আঁটানো:
খুব বেশি চাপ দিয়ে ব্লেড টানালে এটি অতিরিক্ত প্রসারিত হয়ে ফেটে যেতে পারে।
৩. এলোমেলোভাবে করাত চালানো:
নিয়মিত ছন্দ মেনে না কেটে এলোমেলো গতিতে চালালে ব্লেডের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে।
৪. অতিরিক্ত জোরে চালনা:
ব্লেডের গড় গতিবিধি বজায় না রেখে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করলে তা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৫. পাতলা ধাতুর উপর মোটা দাঁতের ব্লেড ব্যবহার:
উপযুক্ত ব্লেড নির্বাচন না করলে ধাতুর ক্ষতি ও ব্লেড ভাঙার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৬. বস্তু দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ না করা:
কাটার সময় কাজের বস্তু সঠিকভাবে ফিক্স না করলে কাঁপুনি সৃষ্টি হয়, যা ব্লেডের স্থায়িত্ব কমায়।
৭. অপরিচ্ছন্ন ও অনিয়মিত ব্যবহারের ফলে:
করাত এবং ব্লেড যথাযথ পরিচর্যা না করলে ব্লেড দুর্বল হয়ে পড়ে।
৮. পুরানো ব্লেডের দ্বারা কাটার পর একই নালীতে নতুন ব্লেড ব্যবহার:
আগের ব্লেডের ক্ষত বা নালীগুলো নতুন ব্লেডের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, যা ভাঙ্গনের কারণ হতে পারে।
৯. কর্তনের শেষ মুহূর্তে চাপ বৃদ্ধি:
কাজ প্রায় শেষ হওয়ার সময় অতিরিক্ত চাপ দিলে ব্লেড ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, বিশেষ করে পূর্বের চাপ কম না করলে।
১০. কাটার বস্তু ভাইস থেকে দূরে থাকলে:
কাজের বস্তু সঠিকভাবে ভাইসে না থাকলে কাটার সময় ব্লেডে অনিয়মিত চাপ পড়ে, যা ভাঙার কারণ হয়।
টিউব বা পাইপ কাটার (Tube or pipe cutter)
পাতলা বা মাঝারি ব্যাসার্ধের পাইপ বা নল কাটার ক্ষেত্রে সাধারণত হ্যাকস ব্যবহৃত হয় যা সহজেই কার্যকর হয়। তবে মোটা বা বড় ব্যাসের পাইপ কাটার ক্ষেত্রে হ্যাকস ব্যবহার করা বেশ অসুবিধাজনক হয়। এই কারণে বড় ব্যাসের টিউব বা পাইপ কাটার জন্য বিশেষায়িত পাইপ কাটার (Pipe Cutter) ব্যবহার করা হয়, যা কাজকে সহজ, দ্রুত ও সুনির্দিষ্ট করে।
চিত্র ১.৮২ এ পাইপ কাটারের আকৃতি ও বিভিন্ন অংশের নাম এবং অবস্থান প্রদর্শিত হয়েছে।
পাইপ কাটার প্রধান অংশগুলো হলো:
- A: ফ্রেম (Frame) — যন্ত্রের প্রধান কাঠামো যা সব অংশকে সংযুক্ত রাখে।
- B: স্লাইড (Slide) — ফ্রেমের সাথে চলমান অংশ, যা হাতলের ঘূর্ণনের সঙ্গে চলতে থাকে।
- C: হাতল (Handle) — ঘুরানোর মাধ্যমে স্লাইড ও কর্তন চাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
- D: গাইড রোলার (Guide Roller) — পাইপকে সঠিকভাবে ধরে রাখতে সাহায্য করে, ফ্রেমের বক্র প্রান্তে যুক্ত থাকে।
- E: কর্তন চাকা (Cutter Wheel) — ‘ভি’ (V) আকৃতির ধারালো চাকাটি, যা পাইপে চাপ দিয়ে কর্তন করে। এটি শক্তিশালী টেম্পার্ড স্টিল থেকে তৈরি।
- F: সেট–স্কু (Set Screw) — হাতলকে নির্দিষ্ট অবস্থানে আটকে রাখে, যাতে অতিরিক্ত ঘূর্ণন না হয়।
পাইপ কাটার ব্যবহারের পদ্ধতি:
হাতল (C) ঘোরালে স্লাইড (B) এবং কর্তন চাকা (E) আস্তে আস্তে গাইড রোলার (D) এর দিকে অগ্রসর হয়। কর্তন চাকা পাইপের উপর চাপ দিয়ে ‘ভি’ আকৃতির কাটা শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে পুরো পাইপ কর্তন হয়ে যায়।
চালনার সময় সেট-স্কু (F) ভিতরের দিকে প্রবেশ করিয়ে দিলে হাতল ঘুরতে বাধা দেয়, যা কাজের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
চিত্র ১.৮২-তে দুটি গাইড রোলারের ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে, কিন্তু বড় বড় পাইপ কাটার জন্য চারটি গাইড রোলার যুক্ত পাইপ কাটার ব্যবহার করা হয়, যা পাইপকে আরও ভালোভাবে সাপোর্ট করে এবং কাটার কাজকে সহজতর করে।
পাইপ কাটার নিয়মাবলী :
পাইপ কাটার প্রক্রিয়া সঠিক ও নিরাপদভাবে সম্পাদনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়মাবলী মেনে চলা আবশ্যক। নিচে পাইপ কাটার নিয়মাবলী ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলো:
১. পাইপ নির্দিষ্টকরণ ও আবদ্ধকরণ:
প্রথমে যেই পাইপটি কর্তন করতে হবে, সেটি পাইপ ভাইস-এ দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করতে হবে। পাইপটি যেন অটুট থাকে এবং কাটার সময় চলাচল না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. পাইপ কাটার সেটআপ:
পাইপ কাটার যন্ত্রের সেট-স্কুটি (Set-screw) ঢিলা করে, কাটার চাকা বা কর্তন চক্রটি এমনভাবে পাইপের উপর স্থাপন করতে হবে যেন কাটার চক্রের মুখ পুরোপুরি পাইপের বক্ররেখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। গাইড রোলারগুলো কিছুটা ঢিলা রেখে দিতে হবে যাতে কাটার চক্র সহজে ঘুরতে পারে।
৩. কাটার চাপ ও ঘোরানোর প্রক্রিয়া:
এরপর হাতলটি ডানদিকে ঘুরিয়ে রোলারগুলোকে পাইপের সাথে সামান্য চাপ দিতে হবে। এ অবস্থায় সেট-স্কুটি ভিতরে ঢুকিয়ে ফ্রেমকে আস্তে আস্তে সামনে-পেছনে দুই থেকে চারবার ঘুরাতে হবে, যাতে কাটার চক্র পাইপে সমানভাবে কর্তন শুরু করে।
৪. কাটার নিয়ন্ত্রণ ও পুনরাবৃত্তি:
পাইপ ভাইসে পাইপটি শক্তভাবে আবদ্ধ থাকায় কাটার চক্র ঘোরানো সহজ হয়। কাটার চক্রে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে মাঝে মাঝে সেট-স্কুটি ঢিলা করে হাতল সামান্য ঘুরিয়ে পুনরায় সেট-স্কুটি ঢুকিয়ে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
৫. পাইপ কর্তন সম্পন্ন:
এই পদ্ধতিতে ফ্রেমটি ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে কাটার চক্রের সাহায্যে পাইপ কর্তিত হয়। পর্যাপ্ত কর্তনের পর পাইপ সম্পূর্ণভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
6 thoughts on “ধাতুনির্মিত পদার্থ কাটার জন্য হ্যাক-স এর ব্যবহার”