ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন করার সাধারণ নিয়ম সম্পর্কে নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের “ইঞ্জিন ওভারহলিং এবং ইঞ্জিনের গোলযোগ, কারণ ও প্রতিকার” বিভাগের একটি পাঠ।
ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন করার সাধারণ নিয়ম
ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন করার সাধারণ নিয়ম:
(১) প্রথমে সকল বৈদ্যুতিক লাইন, ব্যাটারী, হর্ন, হিটার, রেডিও, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদির সংযোগ ইঞ্জিন হতে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
(২) ইঞ্জিন অয়েল (লুবরিকেটিং অয়েল), ড্রেন কর্ক আস্তে আস্তে খুলে ফেলতে হবে।
(৩) রেডিয়েটর এবং ওয়াটার জ্যাকেট ইত্যাদি থেকে পানি বের করে নিতে হবে (রেডিয়েটর ড্রেন কর্ক—এর সাহায্যে)।
(৪) অতঃপর জ্বালানি লাইন বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং এয়ার ক্লিনার, কার্বুরেটর এ.সি. পাম্প, ডিস্ট্রিবিউটর, ইনলেট ও একজস্ট মেনিফোল্ড, ডায়নামো, সেলফ-স্টার্টার ইত্যাদি ইঞ্জিন থেকে পৃথক করতে হবে।
(৫) ইঞ্জিন ট্রান্সমিশন হতে বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং ইঞ্জিন মাউন্টিং বোল্টগুলি খুলে ফেলতে হবে।
(৬) এমতাবস্থায় ইঞ্জিনকে—লোহার চেইন বা রশি দ্বারা ভালভাবে বেঁধে ক্রেনের সাহায্যে অথবা ৫/৬ জন মানুষ ও বাঁশের সাহায্যে চেসিস হতে মেঝেতে নামাতে হবে।
(৭) মেঝেতে ভালভাবে ইঞ্জিন বসিয়ে হেড কভার খুলতে হবে এবং হেড-এর নাট ঢিলা করে রকার আর্মসহ ইঞ্জিন হেড খুলতে হবে।
(৮) ডিজেল ইঞ্জিন হলে ইনজেক্টর, হাইপ্রেসার পাম্প, এয়ার কম্প্রেসর ইত্যাদি খুলতে হবে ।
(৯) এখন ইঞ্জিন কাত করে মেঝেতে রেখে অয়েল সাম্প খুলতে হবে। তারপর অয়েল পাম্প, মেইন এবং বিগ এন্ড (big end) বিয়ারিং খুলতে হবে। তারপর ক্র্যাঙ্কশ্যাফটি ক্র্যাঙ্ককেস থেকে পৃথক করতে হয়।
(১০) ক্র্যাঙ্কশ্যাফট খোলার আগে অবশ্য ফ্লাইহুইল এবং ক্লাচ ইউনিটটি ক্র্যাঙ্কশ্যাফট হতে পৃথক করে রাখতে হবে।
(১১) ক্র্যাঙ্কশ্যাফট খোলার পর ইঞ্জিন ব্লক হতে পিস্টন, পিস্টন রিং এবং কানেকটিং রড খুলে ফেলা হয়।
ক- পিস্টন রিং-এর পিছনের এবং পার্শ্বের ফাঁক দেখানো হয়েছে
খ- পিস্টন রিং-এর পার্শ্বের ফাঁক নির্ণয়ের দৃশ্য
গ— পার্শ্বে ফাক বাড়ানোর জন্যে ঘর্ষণের দৃশ্য
ঘ- পার্শ্বে ফাঁক হওয়ার দৃশ্য
ঙ- অয়েল রিং এর মধ্যে মবিল
বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত যে, যন্ত্রাংশগুলি খুলে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে অথবা গ্যালারিতেও সাজিয়ে রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনবোধে যন্ত্রাংশের গায়ে দাগ বা চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে অথবা কাগজে লিখে রাখা যেতে পারে। খোলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, কোন্ যন্ত্র কিভাবে লাগানো ছিল। পুনরায় এগুলি লাগানোর জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় যন্ত্রাদি খোলা ও লাগানো উচিত। সব যন্ত্রাংশ খোলার পর সেগুলি কেরোসিন তেলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। দুই তিন ঘন্টা পর ব্রাশের সাহায্যে পরিষ্কার করে এবং পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইঞ্জিনের যন্ত্রাদি পরীক্ষা করার নিয়ম
১। সিলিন্ডার :
ইনসাইড মাইক্রোমিটার বা ডায়াল গেজের সাহায্যে বিভিন্ন ক্ষয়প্রাপ্ত সিলিন্ডার নিরূপণ করে দেখতে হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত সিলিন্ডার যদি সর্বোচ্চ ০০৬ হয় এবং
সর্বনিম্ন .০০৪” হয়, তাহলে .০১০” বড় আকারের (over size) পিস্টন এবং পিস্টন রিং লাগবে (এটি যদি এই ইঞ্জিনের প্রথম ওভারহলিং হয়)। ইঞ্জিনে নতুন অবস্থায় যে পিস্টন ব্যবহার করা হয় তাকে স্ট্যাণ্ডার্ড (standared size) পিস্টন বলে। বাজারে সাধারণত .০০১, ০২০”, .০৩০” এবং .০৪০” বড় আকারের পিস্টন ও পিস্টন রিং পাওয়া যায়।
সিলিণ্ডারের সর্বোচ্চ ক্ষয়িষ্ণুতা যতই হোক না কেন, বাজারে প্রাপ্ত সাইজগুলির যে কোন একটির সাইজের সাথে মিল রেখে সিলিন্ডারগুলি বোরিং করতে হয়। তারপর হোনিং বা ল্যাপিং (lapping) করে সিলিন্ডারে লাগাতে হয়। সিলিণ্ডারের প্রতি ইঞ্চি ব্যাসের জন্য ১ থাউ হতে ১.৫০ থাউ ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়। তবে অ্যালুমিনিয়াম পিস্টনের জন্য তিন গুণ ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়। সিলিন্ডার যদি বেশি কম ক্ষয় হয় তবে সিলিন্ডার হোনিং করে শুধু পিস্টন রিং পরিবর্তন করলেই চলে।
২। ক্র্যাঙ্কশ্যাফট ও ক্যামশ্যাফট :
আউটসাইড মাইক্রোমিটার ও ক্র্যাঙ্কশ্যাফট গেজের সাহায্যে ক্ষয়প্রাপ্ত জারনাল ক্র্যাঙ্কপিনগুলি নিরূপণ করে দেখতে হবে। যদি সর্বোচ্চ
৩ থাউ হতে ৪ থাউ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাহলে গ্রাইন্ডিং করে জারনাল ও ক্র্যাঙ্ক পিনগুলিকে একই মাপে আনতে হবে এবং ছোট আকারের শেল বিয়ারিং লাগাতে হবে। বাজারে সাধারণত .০০৫, .০১০”, .০২০”.০৩০ এবং ০৪০” ইঞ্চি ছোট আকারের বিয়ারিং পাওয়া যায়।
ক্ষয় যত কম হোক না কেন ছোট আকার অনুসারেই গ্রাইন্ডিং করে সব জারনাল ও ক্র্যাঙ্ক পিন একই মাপের করতে হবে। তারপর ঐগুলি ক্র্যাঙ্ককেসের সাথে বাঁধতে হবে (মেইন ও বিগ এন্ড বিয়ারিংগুলি)। কানেকটিং রড ধরে ঘুরালে যদি খুব শক্ত মনে হয় তবে হাত দ্বারা গ্রাইন্ডিং করতে হবে অর্থাৎ এমারী কাপড় দ্বারা ক্র্যাঙ্কপিনগুলিকে সবদিকে সমানভাবে ঘর্ষণ করতে হবে। তারপর লুব অয়েল পুনঃসংযোগ করতে হবে।
এখানে সাধারণত ৪/৫ থাউ ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়। যখন এই ক্লিয়ারেন্স ২/৩ থাউ বেশী হয় তখন তা পরিবর্তন করতে হয়। ক্র্যাঙ্কপিন ও জারনালগুলি যদি খুব কম ক্ষয় হয় এবং সামান্য দাগ পড়ে তবে শুধু এমারী কাপড় দ্বারা অতি সতর্কতার সাথে গ্রাইন্ডিং করে দাগ তুলে ফেলতে হয় ।
৩। ইঞ্জিন যতবার খোলা হয় ততবারই হেড গ্যাসকেট ও পিস্টন রিং পরিবর্তন করতে হয়:
যাতে লুবরিকেশনের কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য চাপযুক্ত বাতাসের সাহায্যে রাইফেল
ড্রিলগুলি ভালভাবে পরিষ্কার করতে হয়। তেলের পাম্প খুলে দেখতে হবে এর ড্রাইভ ও ড্রিভেন গিয়ারদ্বয়ের মধ্যে ব্যাকলেশ কত আছে। যদি ব্যাকলেশ ৪/৫ থাউ এর বেশী হয়
তবে গিয়ারদ্বয় পরিবর্তন করতে হবে। এই সময় পাম্পের গ্যাসকেট পরিবর্তন করে দেওয়া ‘ভাল। পানির পাম্প পরীক্ষা করে দেখতে হবে এর বিয়ারিং, শ্যাফট, ইম্পেলার, গ্যাসকেট কার্যক্ষম আছে কিনা। যদি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয় তাহলে পানির পাম্প কীট পরিবর্তন করা উচিত।
৪। একজস্ট ইনলেট ভাল্ভগুলি খুলে দেখতে হবে যে, ভাল্ভের গায়ে লম্বা দাগ বা গর্ত হয়েছে কিনা:
দাগ যদি খুব সামান্য পড়ে তবে হাল্কাভাবে মোবিল দ্বারা একটু গ্রাইন্ডিং করে দেওয়া উচিত। দাগ বেশী হলে প্রথমে গ্রাইন্ডিং পেস্ট এবং পরে মসৃণ পেস্ট দ্বারা গ্রাইন্ডিং পিস্টনের সাহায্যে গ্রাইডিং করে দিলেই হবে। ভাল্ভগুলিকে সিটের উপর রেখেই গ্রাইন্ডিং স্টিকের সাহায্যে গ্রাইন্ডিং করতে হয়।
ভাল্ভ ফেস এবং ভাল্ভ সিট উভয়ই গ্রাইন্ডিং হয় । ভাল্ভ ফেস এবং ভাল্ভ সিট যখন খুব বেশী গর্ত হয়, দাগ পড়ে বা মার খায় তখন ভাল্ভ মাস্টার রিফেসারর সাহায্যে ৩০° অথবা ৪৫°তে ফেসিং করা হয় এবং ভাল্ভ সিটও রিফেসিং করা হয়।
মেশিনে ভাল্ড রিফেসিং-করার পর ভাল্ভগুলি পুনরায় এদের সিটে বসিয়ে মসৃণ (fine) গ্রাইন্ডিং পেস্ট দ্বারা গ্রাইন্ডিং স্টিকের সাহায্যে গ্রাইন্ডিং করতে হয়। ভাল্ভ গ্রাইন্ডিং সঠিক হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্যে ভাল্ভগুলিকে সিটে রেখে একটু পেট্রোল ঢেলে দিলে যদি দেখা যায় পেট্রোল চোয়ায় না তাহলে বুঝতে হবে ভাল্ভ এবং ভাল্ভ সিট সঠিকভাবে গ্রাইন্ডিং করা হয়েছে। ভাল্ভ গাইড ও ক্যাম ফলোয়ারগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হলে বদলী করতে হবে ইঞ্জিন ওভারহলিং করলে অয়েস সীলগুলি বদলী করতে হয় এবং সকল যন্ত্রাংশ সমূহকে সঙ্কুচিত করার পর
৬। কার্বুরেটর সম্পূর্ণ খুলে এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও বর্তনী পরিষ্কার করে পেট্রোল দ্বারা ধৌত করতে হবে এবং চাপযুক্ত বাতাসে আরও ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনবোধে কার্বুরেটরের ফুলকীট বদলী করতে হবে। এতে গাড়ীর তেল খরচ কম হবে।
ডিজেল ইঞ্জিন হলে ইনজেক্টর ও উচ্চচাপ পাম্প পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে এর স্প্রে এবং চাপ ঠিক আছে কিনা। যদি না থাকে তবে পাম্প এবং ইনজেক্টর খুলে এর ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রগুলি বদলী এবং পুনঃসংযোগ করে পুনরায় পরীক্ষা করে ইঞ্জিনে লাগাতে হবে।
৭। ফুয়েল ও অয়েল ফিল্টারগুলি বদলী করে লাগতে হবে। সাইলেন্সার বক্স খুলে ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে মেরামত করে লাগাতে হবে। একজস্ট মেনিফোল্ডগুলির কার্বন ভালভাবে পরিষ্কার করে লাগাতে হবে।
আরও দেখুনঃ
- গ্যারেজ এবং সার্ভিস স্টেশন | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ছোট বড় গোলাকার ছিদ্রের জন্য ড্রিলের ব্যবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ধাতুনির্মিত পদার্থ কাটার জন্য হ্যাক-স এর ব্যবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- স্ক্রেপারের ধরন | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ফাইলিং করার জন্য ভাইস এর ব্যবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- বৈদ্যুতিক যানবাহন