মোটরযান রংকরণ বা পেইন্টিং – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের ” মেটাল ফিটিং, ওয়েল্ডিং-ডেনটিং ও পেইন্টিং” বিভাগ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
মোটরযান রংকরণ বা পেইন্টিং
ডেন্টিং সুসম্পন্ন হওয়ার পর উত্তমরূপে ফাইলিং, গ্রাইন্ডিং এবং সেন্ডিং করতে হয়। এতে বডির উপরিভাগ মসৃণ হয়। ফলে রং করার পর তা আরও সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়। রং এবং রংকরণের উপাদানসমূহ যেমন
বিভিন্ন প্রকার ব্রাশ, তুলি, পুটি (putty), থিনার, এমারী ক্লোথ এবং বিভিন্ন মানের ওয়াটার প্রুফ পেপার (Waterproof paper) বা গ্রীট (Grit) (১০০, ১৮০, ২৪০, ২৮০, ৩২০, ৪০০, ৬০০—মানের) স্প্রে–গান, বাতাসের চাপ, মুখোশ (Masking) মুখোশ টেপ (Masking tape) এবং স্প্রে–মেশিন ভাল না হলে রং করা ভাল হয় না। পুরাতন রং ভাল করে না তুলে রং করা হলে অতি সহজেই সেই রং নষ্ট হয়ে যায় এবং উঠে যায়। রং করার স্থানে যাতে কোন প্রকারেই মরিচা, ধুলাবালি এবং মেটালের চূর্ণ না থাকে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।
রং করার পূর্বে মোটরযানের বড়ি উত্তমরূপে ঘষে–মেজে এবং পুটি দিয়ে ভালভাবে মসৃণ করে নেওয়া দরকার। একবার পুটি দেওয়ার পর ওয়াটারপ্রুফ পেপার এবং পানি দিয়ে ভালভাবে ঘষে মসৃণ করতে হয়। প্রয়োজনে একাধিকবার পুটি ব্যবহার করতে হয়। পুটি দিয়ে মোটরযানটি দুই–তিন দিন শুকানোর জন্য রেখে দিতে হয়। পুটি শুকিয়ে গেলে গ্রীট পেপার বা ওয়াটরাপ্রুফ পেপার দ্বারা সুন্দরভাবে ঘষে–মেজে পরিষ্কার করতে হয়।
‘পুটি শুকিয়ে গেলে প্রথম কোট (coat) রং দিতে হয়। এই কোটের রং শুকিয়ে গেলে ২য় কোর্টের রং দিতে হয়। তবে যদি কোথাও ত্রুটি বা দোষ থাকে বা আছে বলে মনে হয় তবে তা ঘষে–মেজে সুন্দর করে পুনরায় রং করে দিতে হয় যাতে চূড়ান্ত (final) রং করার পূর্বেই সমস্ত ত্রুটি এবং দোষণীয় বিষয়গুলি দূর হয়।
স্প্রে–যন্ত্রপাতির যত্নবিধির একটি সাধারণ সচিত্র প্রতিবেদন ১৭,৮৮ চিত্র দ্বারা দেখানো হল। (১) তীর চিহ্নিত স্থানে প্রতিদিন তেল দিতে হবে, (২) থিনারের ট্রে–তে স্প্রে–গান কখনও ডুবিয়ে রাখতে নেই, (৩) এয়ার ক্যাপের মুখ যদি কখনও বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে তা পরিষ্কার করতে হয়; ভুলক্রমেও পেরেক অথবা তার ব্যবহার করা উচিত নয়, (৪) প্রেশার ফিড ক্যাপ, (৫) সাকশন ফিড ক্যাপ (চিত্রে ৪.৫–এর পার্থক্য দেখানো হল), (৬) সমস্ত নাড়নিং পার্টস (Knurning part) হাতের আঙ্গুল দ্বারা এঁটে দিতে
হয়, (৭) অত্যধিক চাপে এঁটে দিতে হয় না, (৮) রং–করার জন্য হোস পাইপ উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখতে হয়, (৯) ক্যাপ এবং প্রেশার পট খুব ভালভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হয়, (১০) এয়ার রিজার্ভার থেকে প্রতিদিন সঞ্চিত পানি বের করে দিতে হবে। কম্প্রেসরস–এর এয়ার ক্লিনার পরিষ্কার রাখতে হবে। দুই মাস পর পর লুব অয়েল বদলী করে দিতে হবে। কাজের চাপ বেশী থাকলে ১৫ দিন পর পর লুব অয়েল বদলী করে দিতে হয়। এবং ১১– ছাঁকনি দিয়ে সব কিছু ছেঁকে নেওয়া শ্রেয়।
মোটরযানে স্প্রে–পেইন্টিং করার জন্য স্প্রে–বুথ (spray booth) থাকা একান্ত দরকার। বুথে স্প্রে–পেইন্টিং করলে ধুলা–ময়লা পড়ে না, লোকালয় দূষিত হয় না এবং নির্বিঘ্নে শুকাতে পারে। ১৭.৮৯ চিত্রে বুথ স্প্রে–পেইন্টিং করতে দেখা যাচ্ছে।
ইনামের (Enamel), ল্যাকার থিনার (Lacquor thinner) এবং ইনামেল রিডিউসার (Enamel reducer) ইত্যাদি খুবই দাহ্য পদার্থ ; তাই রং করার স্থানে বিশেষ করে বুথে অগ্নিনির্বাপনের সব ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। তাড়াতাড়ি এবং নির্বিঘ্নে শুকানোর জন্য বিশেষ ধরনের ওভেন (Infrared Drying Oven) ব্যবহার করা হয়। এই ওভেনে বিশেষভাবে তৈরি স্বর্ণ–পাতের প্রতিবিম্বের (gold plated reflector) সাহায্যে আলোর বন্যা প্রবাহিত করে দেওয়া হয় যার প্রভাবে রং নিখুঁতভাবে শুকাবার প্রয়াস পায়। ১৭.৯০ চিত্রে একটি ওভেন দেখানো হয়েছে, যেখানে মোটরযান রং করার সব ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে।
মোটরযানের বিভিন্ন অংশ ডেন্টিং করার জন্য বডির বিভিন্ন অংশের নাম জানা দরকার যাতে ডেন্টিং কার্য সম্পাদনের জন্য কোন কোন যন্ত্রপাতি দরকার হতে পারে তার তালিকা প্রস্তুত করতে সুবিধা হয়। ১৭.৯১ এবং ১৭,৯২ চিত্র দ্বারা মোটরযানের বিভিন্ন অংশ খোলামেলাভাবে দেখানো হয়েছে। (১) রুফ প্যানেল (roof panel), (২) হুড (Hood). (৩) ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল (Instrument panel), (৪) ডিক লীড (Deck Lead),
(৫) ফিলার নেক কভার (filler neck cover), (৬) পিছনের কোয়ার্টার প্যানেল (rear quarter panel), (৭) মেঝের পাত্র (floor pan), (৮) রকার প্যানেল (Rocker panel), (৯) বাইরের চাকার হাউজ প্যানেল (Outer wheel house panel), (১০) সেন্টার পিলার (centre piller),
(১১) পিছনের দরজা (Rear door), (১২) সম্মুখের দরজা (Front door), (১৩) সম্মুখের ফেন্ডার (Front fender), (১৪) গ্রীল প্যানেল বর্ধিতাংশ (Grill panel extension), (১৫) সম্মুখের কব্জার পিলার (Front hrnge piller), (১৬) সর্বনিম্ন প্যানেল (১৭) রেডিয়েটর গ্রীল প্যানেল (Radiator grill panel), (১৮) ফেন্ডার স্প্ল্যাশ শীট (Fender splash sheet) |
১৭.৯২ চিত্রের বিভিন্ন অংশের নাম : (১) মোল্ডিং (Moulding), (২) ফেডার (Fender), (৩) কাদা প্রতিরোধক (mud guard), (৪) স্প্ল্যাশ শীলড (Splash shield), (৫) পেট্রোল ট্যাঙ্ক নেক দরজা (petrol tank neck door), (৬) কব্জার পিন (Hinge pin), (৭) রানিং বোর্ড ব্রাকেট (Running board bracket), (৮) মোল্ডিং (Moulding), (৯) রানিং বোর্ড (Running board), (১০) মোল্ডিং (Moulding), (১১) রানিং বোর্ড ব্রাকেট (runnig board bracket), (১২) কাদা প্রতিরোধক (mud guard), (১৩) ফেন্ডার।
ফিদার এজিং (Feather edging) :
মোটরযানের পুরাতন রং ২৪০ গ্রেডের ওয়াটারপ্রুফ পেপার দ্বারা ঘষে–মেজে তুলে ফেলার পদ্ধতিকে ফিদার এজিং বলে। নির্দিষ্ট গ্রেডের ওয়াটারপ্রুফ পেপার কাঠের অথবা রবারের ব্লকের সাথে জড়িয়ে পানির সাহায্যে ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরাতন রং তুলে ফেলা হয়। ঘর্ষণের সময় যাতে সর্বদা পানি পাওয়া যায় তার জন্য স্পঞ্জ (sponge) ভিজিয়ে রাখা হয়। প্রয়োজনবোধে চাপ দিয়ে পানি দেওয়া হয়।
ঘর্ষণের সময় পানি সরবরাহ ভাল থাকলে পেপার দীর্ঘায়ু হয় এবং কাটেও তাড়াতাড়ি। এতে ঘর্ষণ বেশ মসৃণ হয়।
মুখোশীকরণ (Masking) :
গাড়ী রং করা এবং ঘর্ষণের সময় যাতে হেড লাইট, ইণ্ডিকেটিং লাইট, উইণ্ড শীল্ড, টেইল লাইট, জানালার গ্লাস, দরজার হ্যাণ্ডেল, নিকেল করা বিভিন্ন দ্রব্য নষ্ট না হয় তার জন্য মাসকিং পেপার দ্বারা ঢেকে রাখা প্রয়োজন। এই পেপার ওয়াটারপ্রুফ পেপারের ন্যায় কাজ করে। এর একপার্শ্বে আঠা লাগানো এবং অন্য পার্শ্ব মসৃণ।
এটি প্লাস্টিক ট্যাপের ন্যায় রোল করা থাকে। এটি থেকে ২” চওড়া হয়ে থাকে। মাসকিং ট্যাপ দ্বারা অন্য কাগজ প্রয়োজনীয় স্থানে এঁটে দেওয়া যায়। যেখানে নতুন রং করা হবে তার ১৮” এর মধ্যে মাসকিং করে নেওয়া উত্তম।
প্রোথিত প্রলেপ (Foundation Coats ) :
গাড়ী রং করার সময় সর্বশেষ প্রলেপ (coat) দেওয়ার আগে একাধিক প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রথম প্রলেপ দেওয়ার জন্য যে দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয় তাকে প্রাইমার (primer) বলে। এর মূল কাজ হচ্ছে উন্মুক্ত ধাতব পদার্থের সাথে রং যাতে ভালভাবে লাগতে পারে তার পথ সুগম করা।
দ্বিতীয় প্রোথিত প্রলেপ হিসাবে যেসব দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তাকে সারফেসার বলে (surfacer)। সব দাগ, অসমতল স্থান ইত্যাদি দূর করার জন্য একাধিক সারফেসার প্রলেপ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সাধারণ প্রলেপের জন্য প্রাইমার সারফেসার নামে একটি সম্মিলিত প্রলেপ দ্রব্য পাওয়া যায় যার সাহায্যে রং করার শুভ সূচনা করা যায়। রং করা প্রশিক্ষণের জন্যও ভাল।
স্প্রে–গান (Spray Gun) : ১৭.৯৫ চিত্রে স্প্রে—গানের বিভিন্ন অংশ এবং কার্য প্রণালী দেখানো হল : (১) রং এর পরিমাণ সমন্বয়কারী (material adjustment), (২) বাতাসের সাহায্যে স্প্রে–এর আকার–আকৃতি সমন্বয়কারী (pattern adjustment throught air), (৩) ফ্লুইড নিডল (Fluid needle), (৪) ফ্লুইড টিপ (Fluid tip), (৫) এয়ার হর্ন (Air Horns), (৬) নজল (Nozzle), (৭) এয়ার ক্যাপ (Air cap) (৮) ছিদ্র (Vent), (৯) এয়ার ভাল্ভ (Air valve), (১০) রং–এর পাত্র ( Paint pan), (১১) বাতাস (air), (১২) রং (paint) |
এনামেল রং (Enamel paint) এবং বার্নিশ (Lacquor) উভয়ই গাড়ীতে ব্যবহার করা হয়। তবে সাধারণ এনামেল রং গাড়ীতে ব্যবহার করা হয়, যেমন– বাস, ট্রাক, মিনিবাস ইত্যাদি। এইসব গাড়ী সাধারণত ব্রাশের সাহায্যে রং করা হয়। গাড়ীতে যেসব রং স্প্রে করে করা হয় তাকে কার পেইন্ট (Car paint) বলে।
সাধারণ পেইন্ট থেকে কার পেইন্টের মূল্য বেশী এবং উন্নতমানের ও বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। কিছু কিছু স্প্রে–গান আছে যেগুলোতে একাধিক এয়ার হোল (air hole) থাকে। এগুলোকে এয়ার জেটও বলা হয়। বেশী এয়ার জেট থাকার সুবিধা হচ্ছে যে, গাঢ় (sticky or more viseous) সিনথেটিক এনামেল পেইন্ট বেশী বাতাসের চাপে সহজে স্প্রে করা যায়। রং–এর ফোয়ারা সমন্বয় করা হয় হর্নহোল দিয়ে বাতাস কম–বেশী করার মাধ্যমে। কাজের পরিসরের সাথে তাল মিলিয়ে তা করা হয়। ছোটখাট দাগ বা সরু জায়গায় রং করার
সময় রং–এর ফোয়ারা ছোট এবং গোলাকার করা হয়। তবে সাধারণত প্রশস্ত আকারের ফোয়ারা দিয়ে স্প্রে–প্রেইন্টিং করা হয়ে থাকে। ১৭.৯৮ চিত্রে তা সঠিকভাবে দেখনো হল। রং করার সময় মনে রাখতে হবে যে, বডির যেসব অংশে রং চটে গেছে বা উঠে গেছে সেসব জায়গা এক বা একাধিক কোট (coat) অর্থাৎ প্রাইমার সারফেসার দ্বারা আচ্ছাদিত করা উচিত। দুই ধরনের রং ব্যবহার না করে প্রাইমার সারফেসার রং ব্যবহার করা শ্রেয়। গাড়ীর চূড়ান্ত রং–এর কোট যদি বার্নিশ বা ল্যাকার দ্বারা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে গাড়ীতে ল্যাকার প্রাইমার–সারফেসার ব্যবহার করতে হবে।
সেইরূপ চূড়ান্ত কোট যদি সিনথেটিক এনামেল হয়, তা হলে প্রথমে সিনথেটিক এনামেল প্রাইমার সারফেসার ব্যবহার করতে হয়। ল্যাকার প্রাইমার সারফেসার খুব তাড়াতাড়ি অর্থাৎ কয়েক মিনিটের মধ্যে শুকিয়ে যায়। পক্ষান্তরে সিনথেটিক এনামেল প্রাইমার–সারফেসার ভালভাবে শুকাতে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় লাগে। গাড়ীতে স্প্রে–পেইন্টিং করার সময় স্প্রে–গান গাড়ীর বডি হতে মাত্র আট ইঞ্চি দূরে রাখা দরকার। এতে স্প্রে ভাল হয়। ১৭.১০৩ চিত্রে এটি দেখানো হল।
আরও দেখুনঃ
2 thoughts on “মোটরযান রংকরণ বা পেইন্টিং”