গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশন – আজকের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি “অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের একটি মৌলিক ও অপরিহার্য অংশ, যা যানবাহনের গতি ও শক্তি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশন সিস্টেম ইঞ্জিনের উৎপন্ন শক্তিকে চাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয় উপযুক্ত অনুপাতে, যাতে ইঞ্জিন সর্বোচ্চ দক্ষতায় কাজ করতে পারে। এই পাঠে আমরা গিয়ার বক্সের প্রকারভেদ, কার্যপ্রণালী এবং এর উপাদানসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা একজন শিক্ষার্থী বা প্রযুক্তিবিদের জন্য বাস্তব প্রয়োগে অত্যন্ত সহায়ক হবে।
গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশন
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিভিন্ন গাড়িতে অটোমেটিক ট্রান্সমিশন ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরনের ট্রান্সমিশন সিস্টেমে গিয়ার পরিবর্তনের জন্য ড্রাইভারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় না। ইঞ্জিন চালু অবস্থায় গাড়ির গতি ও বোঝার উপর ভিত্তি করে গিয়ার পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। অটোমেটিক ট্রান্সমিশনের এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত ফ্লুইড কাপলিং বা টর্ক কনভার্টার (Fluid Coupling or Torque Converter) ব্যবহৃত হয়, যা শক্তি সঞ্চালন ও গতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ব্যবস্থার ফলে গাড়ি চালানো আরও সহজ, আরামদায়ক ও দক্ষ হয়।
গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশনের উদ্দেশ্য :
গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো গাড়ির গতি ও টর্ক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা। এটি গিয়ারের সাহায্যে ইঞ্জিনের শক্তিকে বিভিন্ন অনুপাতে পরিবর্তন করে প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ি স্থির অবস্থায় থাকলে প্রথমে নিম্ন গিয়ারে ধীরে চলা শুরু করে, পরে মধ্য গতি এবং শেষ পর্যন্ত উচ্চ গতি অর্জন করে।
প্রয়োজনবোধে গাড়িকে পিছনের দিকেও চালানো যায়, যা রিভার্স গিয়ার দ্বারা সম্পন্ন হয়। গিয়ার বক্স ইঞ্জিন ও পিছনের চাকাগুলোর মধ্যে উপযুক্ত অনুপাত বজায় রেখে কাজ করে, যাতে শক্তি সঞ্চালন সুষ্ঠুভাবে ঘটে। গিয়ার পরিবর্তনের জন্য গিয়ার বক্সে একটি শিফটিং লিভার বা গিয়ার লিভার থাকে, যা চালক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে গিয়ার নির্বাচন করে থাকেন।
গিয়ার বক্সের প্রকারভেদ:
গিয়ার বক্স সাধারণভাবে দুইটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত:
১। হস্তচালিত (ম্যানুয়াল) গিয়ার বক্স
২। স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক) গিয়ার বক্স
হস্তচালিত গিয়ার বক্সের প্রকারভেদ:
- স্লাইডিং মেশ (Sliding Mesh)
- সিনক্রোমেশ (Synchromesh)
স্লাইডিং মেশ গিয়ার বক্সে শুধুমাত্র গিয়ার সংযুক্তির মাধ্যমে পাওয়ার সঞ্চারিত হয়। অপরদিকে, সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্সে সিনক্রোনাইজার ইউনিট ব্যবহৃত হয়, যা গিয়ার পরিবর্তনকে মসৃণ করে।
স্বয়ংক্রিয় গিয়ার বক্সের প্রকারভেদ:
- হাইড্রোমেটিক টাইপ
- টর্ক কনভার্টার টাইপ
স্বয়ংক্রিয় গিয়ার বক্সে যখন হাইড্রলিক ও বৈদ্যুতিক পদ্ধতির সমন্বয় থাকে, তখন একে সেমি-অটোমেটিক গিয়ার বক্স বলা হয়।
স্পিড অনুযায়ী গিয়ার বক্সের শ্রেণিবিন্যাস:
- থ্রি-ফরোয়ার্ড স্পিড
- ফোর-ফরোয়ার্ড স্পিড
- টেন-ফরোয়ার্ড স্পিড (যা সাধারণত হেভি ডিউটি যানবাহনে ব্যবহৃত হয়)
সাধারণত একটি গিয়ার বক্সে তিনটি সম্মুখগতি (Forward Gear) ও একটি পশ্চাৎগতি (Reverse Gear) থাকে।
স্লাইডিং মেশ গিয়ার বক্সের উপাদানসমূহ:
স্লাইডিং মেশ গিয়ার বক্স নিম্নলিখিত যন্ত্রাংশ দ্বারা গঠিত:
১। বিয়ারিং: ৬৩০৮, ৬৩০৭, ৬২১০ NR, ৬২০৮
২। শিফটিং লিভার
৩। শিফটার ইয়র্ক
৪। ট্রান্সমিশন ইনপুট শ্যাফট (ক্লাচ গিয়ার)
৫। ট্রান্সমিশন আউটপুট শ্যাফট
৬। কাউন্টার শ্যাফট ড্রিভেন গিয়ার
৭। কাউন্টার শ্যাফট সেকেন্ড গিয়ার
৮। কাউন্টার শ্যাফট লো গিয়ার
৯। কাউন্টার শ্যাফট
১০। ট্রান্সমিশন মেইন শ্যাফট সেকেন্ড গিয়ার ও হাই স্পীড গিয়ার
১১। ট্রান্সমিশন মেইন শ্যাফট লো ও রিভার্স গিয়ার
১২। গিয়ার বক্স কেসিং
১৩। রিভার্স আইডেলার গিয়ার
প্রথম গতির গিয়ার (First Gear):
যখন গিয়ার পরিবর্তন করতে হয়, তখন প্রথম ধাপে ক্লাচ প্যাডেল চেপে ক্লাচ আলাদা করতে হয়, যাতে ইঞ্জিন ও গিয়ার বক্সের সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর গিয়ার শিফটিং লিভার ব্যবহার করে ট্রান্সমিশন মেইন শ্যাফটের বড় গিয়ারটি এমনভাবে সরানো হয়, যাতে এটি কাউন্টার শ্যাফটের সবচেয়ে ছোট গিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ক্লাচ যুক্ত থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনের উৎপন্ন শক্তি প্রথমে ক্লাচ গিয়ারে, তারপর কাউন্টার শ্যাফট ড্রিভেন গিয়ারে প্রবাহিত হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ক্লাচ গিয়ার এবং কাউন্টার শ্যাফট ড্রিভেন গিয়ার সবসময়ই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। যখন মেইন শ্যাফটের বড় গিয়ার এবং কাউন্টার শ্যাফটের ছোট গিয়ার একত্রে যুক্ত হয়, তখন সেই সংযোগের মাধ্যমে শক্তি পরিবাহিত হয়ে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ গতির অনুপাত কাজ করে: বড় গিয়ার ছোট গিয়ারের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বড়, অর্থাৎ ছোট গিয়ার তিনবার ঘুরলে বড় গিয়ার একবার ঘুরে। ফলে প্রথম গিয়ারে গাড়ির ইঞ্জিন অনেক বেশি গতিতে ঘুরলেও চাকা তুলনামূলকভাবে কম ঘোরে। ডিফারেনশিয়াল গিয়ারের মাধ্যমে গতি আরও হ্রাস পায়, যেমন—ইঞ্জিনের ১২ বার ঘূর্ণনের বিপরীতে চাকা মাত্র ১ বার ঘোরে (অনুপাত ১২:১)।
এই কারণে প্রথম গিয়ারে ইঞ্জিন থেকে প্রচুর টর্ক (ঘূর্ণন শক্তি) পাওয়া যায়, কিন্তু গতি কম থাকে। এ গিয়ার মূলত ব্যবহৃত হয়—
ব্রিজ বা উঁচু ঢাল বেয়ে উঠার সময়
পাহাড়ি বা উঁচু-নিচু পথ অতিক্রম করতে
ছোট বা গভীর গর্তে পড়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে
গাড়ির সর্বোচ্চ টান বা শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনে
এমন অবস্থায় প্রথম গিয়ারের সাহায্যে যদি গাড়ি বাধা অতিক্রম করতে না পারে, তাহলে অন্য কোনো গিয়ারেও তা সম্ভব নয়। তবে মনে রাখতে হবে, প্রথম গিয়ারে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালালে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে, তাই শুধুমাত্র প্রয়োজন অনুযায়ীই এই গিয়ার ব্যবহার করা উচিত।
নিরপেক্ষ অবস্থান (Neutral Position):
গিয়ার বক্সে একটি নিরপেক্ষ বা নিউট্রাল অবস্থান থাকে, যেখানে কাউন্টার শ্যাফটের কোনো গিয়ারই মেইন শ্যাফটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে না। এই অবস্থায় ইঞ্জিন চালু থাকলেও চাকার দিকে কোনো শক্তি সঞ্চারিত হয় না।
প্রতিবার গিয়ার পরিবর্তনের সময়, গিয়ার শিফটিং লিভারের সাহায্যে প্রথমে গিয়ার বক্সকে নিউট্রাল অবস্থায় আনতে হয় এবং পরে কাঙ্ক্ষিত গিয়ারে স্থানান্তর করতে হয়। সাধারণত গিয়ার পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট একটি ধারা অনুসরণ করা হয়—
প্রথম গতি → দ্বিতীয় গতি → তৃতীয় গতি, অর্থাৎ নিম্ন গতি → মধ্য গতি → উচ্চ গতি—এই ক্রমেই গিয়ার পরিবর্তন করলে মসৃণ এবং দক্ষ ড্রাইভিং নিশ্চিত হয়।
দ্বিতীয় গতির গিয়ার (Second gear) :
দ্বিতীয় গিয়ারে গাড়ির গতি প্রথম গিয়ারের তুলনায় অনেক বেশি হয় এবং গিয়ারের সংযুক্ত অবস্থাও পরিবর্তিত হয়। এই অবস্থায় কাউন্টার শ্যাফটের (লে শ্যাফট) দ্বিতীয় গিয়ারটি সংযুক্ত থাকে মেইন শ্যাফটের দ্বিতীয় ও হাইস্পিড গিয়ারের সঙ্গে। শক্তি প্রবাহের পথ হলো: প্রথমে ক্লাচ গিয়ার, এরপর কাউন্টার শ্যাফটের ২য় গিয়ার, সেখান থেকে মেইন শ্যাফটের ২য় ও হাইস্পিড গিয়ার হয়ে অবশেষে ডিফারেনসিয়ালে পৌঁছে।
এই অবস্থায় গিয়ার অনুপাত হয় ২:১, অর্থাৎ ক্র্যাঙ্কশ্যাফট দুইবার ঘুরলে মেইন শ্যাফট একবার ঘুরে। ডিফারেনসিয়ালে প্রবেশের পর এই অনুপাত দাঁড়ায় প্রায় ৮:১, অর্থাৎ ক্র্যাঙ্কশ্যাফট আটবার ঘুরলে চাকা একবার ঘুরে। পাঠ্যপুস্তকের চিত্র ৫.১-এর মাধ্যমে এই গিয়ারের সংযোগ ও কার্যপদ্ধতি দৃশ্যত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তৃতীয় গতির গিয়ার (Third gear) :
তৃতীয় গিয়ারটি গাড়ির সর্বোচ্চ গতির জন্য ব্যবহৃত হয়। এই গিয়ারে ক্র্যাঙ্কশ্যাফট যতবার ঘুরে, মেইন শ্যাফটও ততবারই ঘোরে, অর্থাৎ এখানে গিয়ার অনুপাত হয় ১:১। এই পর্যায়ে মেইন শ্যাফটের কোনো গিয়ারই কাউন্টার শ্যাফটের গিয়ারের সঙ্গে যুক্ত থাকে না; বরং মেইন শ্যাফটের দ্বিতীয় ও উচ্চগতির গিয়ারটি সরাসরি ক্লাচ গিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
ডিফারেনসিয়ালে পৌঁছানোর পর চূড়ান্ত গিয়ার অনুপাত হয় ৪:১, অর্থাৎ ক্র্যাঙ্কশ্যাফট চারবার ঘুরলে চাকা একবার ঘুরে। চিত্র ৫.১-এ তৃতীয় গিয়ারের অবস্থান ও সংযোগ পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে।
পশ্চাৎ গতির গিয়ার (Reverse gear) :
রিভার্স গিয়ারের মাধ্যমে গাড়ি পিছনের দিকে চলে এবং এর গতি সাধারণত ধীর হয়। যদিও কোনো কোনো যানবাহনে পশ্চাৎ গতি তুলনামূলকভাবে একটু বেশি হতে পারে। এই গিয়ারে শক্তি সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত হয় গিয়ার শিফটিং লিভার এবং ফর্ক (Fork)।
মেইন শ্যাফটের লো ও রিভার্স গিয়ারটি এই অবস্থায় সংযুক্ত হয় কাউন্টার শ্যাফটের রিভার্স গিয়ার এবং রিভার্স আইডেলার গিয়ারের সঙ্গে। এখানে কাউন্টার শ্যাফটের রিভার্স ও রিভার্স আইডেলার গিয়ার একই দিকে ঘোরে, কিন্তু মেইন শ্যাফটের রিভার্স গিয়ার উল্টো দিকে ঘোরে। ফলে গাড়ির গতির দিক বিপরীত হয় এবং গাড়ি পেছনের দিকে চলে। পাঠ্যপুস্তকের চিত্র ৫.১-এ এই গিয়ারের সংযোগ ও কার্যপদ্ধতি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্স (Synchromesh Gear Box) :
সাধারণ স্লাইডিং মেশ গিয়ার বক্সে গিয়ার পরিবর্তনের সময় বেশ শব্দ হয় এবং গিয়ার পরিবর্তন সহজে করা যায় না। এতে গিয়ারের দাঁত নষ্ট হয়ে যাওয়া বা গিয়ার ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই ধরনের সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য আধুনিক যানবাহনে এখন সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্স ব্যবহার করা হয়, যা গিয়ার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে মসৃণ, নিরব ও ঝুঁকিমুক্ত করে তোলে।
সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্সেও স্লাইডিং মেশ গিয়ারের মতো বিভিন্ন গিয়ার থাকে, তবে এর বিশেষত্ব হলো সিনক্রোনাইজার অ্যাসেম্বলি। এই অ্যাসেম্বলি গিয়ার পরিবর্তনের সময় মেইন শ্যাফট এবং গিয়ারের গতি পার্থক্য দূর করে একে অপরের সাথে সমন্বয় সাধন করে। ফলে গিয়ার মসৃণভাবে পরিবর্তিত হয়।
সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্সের মূল উপাদানসমূহ:
সিনক্রোনাইজার অ্যাসেম্বলিতে সাধারণত নিচের উপাদানগুলো থাকে:
১। সিনক্রোনাইজার রিং
২। সিনক্রোনাইজার রিং স্প্রিং
৩। সিনক্রোনাইজার হাব
৪। সিনক্রোনাইজার স্লিভ (Sleeve)
স্লিভের চারপাশে খাঁজ কাটা থাকে এবং সেখানে একটি ‘ডগ’ (dog) বা ‘যক’ বসানো থাকে। গিয়ার পরিবর্তনের সময় এই স্লিভ বাম অথবা ডানদিকে সরিয়ে নির্দিষ্ট গিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। তখনই গাড়ি সেই গিয়ারের অনুপাত অনুযায়ী চলতে শুরু করে।
এই গিয়ার বক্সে মেইন শ্যাফট ও কাউন্টার শ্যাফটের গিয়ারগুলো সবসময় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। গিয়ার পরিবর্তন করা হয় শুধুমাত্র সিনক্রোনাইজার ইউনিটের মাধ্যমে, যা রোটেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্সে গিয়ার পরিবর্তনের সাধারণ বিন্যাস হলো:
নিউট্রাল → ১ম গিয়ার → ২য় গিয়ার → ৩য় গিয়ার → ৪র্থ গিয়ার → (প্রয়োজনে) রিভার্স গিয়ার।
‘সিনক্রোমেশ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
সিনক্রোনাইজ (Synchronize): একই সময়ে, একই সাথে কাজ করানো।
মেশ (Mesh): পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়া বা সামঞ্জস্যপূর্ণ সংযোগ।
সিনক্রোমেশ গিয়ার বক্সের মাধ্যমে গিয়ার পরিবর্তন একটি বাস্তব উদাহরণে বোঝা যায়—
যদি প্রথম এবং রিভার্স গিয়ার পরিচালনার জন্য নির্ধারিত সিনক্রোনাইজার ইউনিটকে বাম দিকে ঘোরানো হয়, তবে স্লিভ সিনক্রোনাইজার রিং-এর মাধ্যমে প্রথম গিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এরপর মেইন শ্যাফটের মাধ্যমে পাওয়ার ডিফারেনসিয়ালে প্রবাহিত হয়ে চাকা চালিত হবে।
এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত একটি চিত্রের মাধ্যমে আরও সহজে বোঝানো যায়।
ইঞ্জিন চালু ও গিয়ার নিউট্রাল অবস্থা:
ইঞ্জিন চালু থাকলেও যদি গিয়ার নিউট্রাল অবস্থায় থাকে, তাহলে গাড়িটি চলাচল করে না। এ অবস্থায় ইঞ্জিনের শক্তি ক্লাচ ডিস্কের মাধ্যমে ক্লাচ গিয়ার হয়ে শুধুমাত্র কাউন্টার শ্যাফটে সঞ্চারিত হয়। তবে যেহেতু গিয়ার সিস্টেম নিরপেক্ষ (নিউট্রাল), তাই এই শক্তি চাকার দিকে প্রেরিত হয় না। ফলে গাড়িটি স্থির থাকে।
এই অবস্থায় কেবলমাত্র দুটি শ্যাফট ঘূর্ণায়মান থাকে:
ক্লাচ শ্যাফট
কাউন্টার শ্যাফট (Lay Shaft)
কারণ, এই দুটি শ্যাফট একে অপরের সাথে যান্ত্রিকভাবে সংযুক্ত। তবে যেহেতু মেইন শ্যাফট ও ড্রাইভ শ্যাফটের সঙ্গে গিয়ার সংযোগ হয় না, তাই সেগুলো ঘোরে না।
শব্দ নির্ণয় পদ্ধতি:
গাড়ি চলন্ত অবস্থায় যদি কোনো অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যায়, তবে শব্দটি ইঞ্জিন থেকে না গিয়ার বক্স থেকে—তা নির্ণয় করার জন্য একটি সাধারণ পরীক্ষা করা যায়।
পরীক্ষার ধাপ:
১। গাড়িটিকে স্থির অবস্থায় রাখুন।
২। ইঞ্জিন চালু করুন এবং গিয়ার নিউট্রাল রাখুন।
৩। লক্ষ্য করুন শব্দ হচ্ছে কি না।
যদি শব্দ না হয়, তাহলে গিয়ার বক্সই শব্দের উৎস।
কিন্তু যদি শব্দ তখনও হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় ইঞ্জিনের কোনো অংশই শব্দের কারণ।
এই পদ্ধতিতে শব্দের উৎস শনাক্ত করা সহজ হয় এবং উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
নতুন গিয়ার বক্সের তেল পরিবর্তন ও পরিষ্কার:
নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে সাধারণত ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ মাইল চালনার পর গিয়ার বক্সের তেল পরিবর্তন করা উত্তম। কারণ এই সময়ের মধ্যে নতুন যন্ত্রাংশ ঘষামাজা ও পরস্পরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ময়লা, ধাতব কণা বা পরিশ্রান্ত তেল জমে যায়।
তেল পরিবর্তনের ধাপ:
১। পুরোনো গিয়ার অয়েল সম্পূর্ণরূপে বের করে ফেলতে হবে।
২। এরপর কেরোসিন তেল দিয়ে গিয়ার বক্সটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
৩। শুকিয়ে নিয়ে নতুন ও উপযুক্ত গ্রেডের গিয়ার অয়েল দিয়ে পূর্ণ করতে হবে।
এভাবে তেল পরিবর্তনের মাধ্যমে গিয়ার বক্সের স্থায়িত্ব ও কর্মক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
ওভার ড্রাইভ ও এর প্রয়োজনীয়তা:
ওভার ড্রাইভ হলো একটি অতিরিক্ত গিয়ারিং ব্যবস্থা যা ইউনিট গিয়ার বক্সের পরে যুক্ত হয় এবং এটি গাড়ির গতিশীলতা ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ইঞ্জিনের ঘূর্ণন হার কমিয়ে রেখে ড্রাইভিং শ্যাফটের গতি বৃদ্ধি করা।
উদাহরণস্বরূপ:
যদি ইঞ্জিন প্রতি মিনিটে ৮০ বার ঘোরে, তখন ওভার ড্রাইভ ব্যবহারে প্রোপেলার শ্যাফট প্রতি মিনিটে ১০০ বার ঘুরে। এতে করে—
ইঞ্জিনের চাপ কমে যায়
জ্বালানি খরচ কম হয়
যান্ত্রিক ঘর্ষণ ও কম্পন হ্রাস পায়
গাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়
এই কারণেই অনেক আধুনিক গাড়িতে ওভার ড্রাইভ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।
6 thoughts on “গিয়ার বক্স বা ট্রান্সমিশন”