ক্লাচের প্রকারভেদ- এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের “কুলিং এবং ট্রান্সমিশন পদ্ধতি” অধ্যায়ের একটি পাঠ।
ক্লাচের প্রকারভেদ | কুলিং এবং ট্রান্সমিশন পদ্ধতি | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
গাড়িতে সাধারণত আট প্রকার ক্লাচের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন :
১। মেকানিক্যাল ক্লাচ (mechanical clutch) ২। হাইড্রলিক ক্লাচ (hydraulic clutch)
৩। কয়েল স্প্রিং ক্লাচ (coil spring clutch)
৪। ডায়াফ্রাম ক্লাচ (diaphragm clutch)
৫। সিঙ্গল প্লেট ক্লাচ (single plate clutch)
৬। মালটি প্লেট ক্লাচ (multi plate clutch)
৭। ম্যাগনেটিক ক্লাচ (magnetic clutch)
৮। সেমি সেন্ট্রিফিউগ্যাল ক্লাচ (semi centrifugal clutch) সাধারণভাবে মেকানিক্যাল এবং হাইড্রোলিক ক্লাচের ব্যবহার বেশী দেখা যায়।
মেকানিক্যাল ক্লাচ কিভাবে কাজ করে :
কয়েল স্প্রিং টাইপ মেকানিক্যাল ক্লাচ ক্লাচ ফ্লাই হুইলের সাথে বেল্টের সাহায্যে যুক্ত অবস্থায় থাকে। ক্লাচ হাব স্পাইন ক্লাচ শ্যাফট স্পাইনের সাথে চাপ যুক্ত থাকে। প্রেসার প্লেট ক্লাচ ডিস্ককে ফ্লাই হুইলের সাথে চাপ যুক্ত করে রাখে। ফলে ফ্লাই হুইল ঘুরলে ক্লাচ ডিস্ক ঘুরবে এবং ক্লাচ শ্যাফটও ঘুরবে এবং পাওয়ার গিয়ার বাক্সে যাবে। ঐ সময় যে গিয়ারে গাড়ি থাকবে সেই গিয়ার অনুপাতেই গাড়ি চলবে।
ক্লাচ প্যাডেলে চাপ প্রয়োগ করলে ঐ চাপ ক্লাচ ফর্ক, রিলিজ বিয়ারিং এবং রিলিজ লিভারের মাধ্যমে প্রেসার প্লেটে যায়। উক্ত চাপের ফলে প্রেসার প্লেটের স্প্রিংগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ফলে প্রেসার প্লেটে ক্লাচ ডিস্ককে বা ক্লাচ প্লেটকে ফ্লাই হুহলের সঙ্গে চাপযুক্ত করে রাখতে পারে না, যার ফলশ্রুতিতে শক্তি আর সরবরাহ হতে পারে না। আবার যখন ক্লাচ প্যাডেল থেকে আস্তে আস্তে চাপমুক্ত করে দেওয়া হয় তখন ক্লাচ পুনরায় যুক্ত হয়। প্রতিবার গিয়ার পরিবর্তন করার সময় ক্লাচ বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। ক্লাচ বিচ্ছিন্ন না করলে গিয়ার পরিবর্তন খুবই দুরূহ ব্যাপার হবে এবং গিয়ারের দাঁতগুলি ভেঙ্গে যাবে।
হাইড্রলিক ক্লাচ :
বর্তমানে বহু গাড়িতে হাইড্রলিক ক্লাচের ব্যবহার দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে ক্লাচ প্যাডেলে চাপ কম দিলেও প্রেসার ঠিকই পাওয়া যায়। এই জাতীয় ক্লাচে Fore প্রেসার খুব বেশী থাকে বিধায় হেভি ডিউটি ক্লাচের জন্য এর ব্যবহার খুব বেশী। এই পদ্ধতিতে ক্লাচ প্যাডেল, মাস্টার সিলিন্ডার রিজার্ভ ট্যাঙ্ক (ব্রেক অয়েল, ) ক্লাচ হোজ পাইপ, সারভো সিলিন্ডার থাকে। সারভো সিলিন্ডার এবং মাস্টার সিলিন্ডারের মধ্যে রাবারের বাকেট এবং পিস্টন থাকে।
ড্রাইভার যখন ক্লাচ প্যাডেলের উপর চাপ প্রয়োগ করে তখন মাস্টার সিলিন্ডারের পুশ রড মাস্টার সিলিন্ডারের তেলের উপর বাকেট এবং পিস্টনের সাহায্যে চাপ দেয়। ঐ চাপের ফলে তেল মাস্টার সিলিন্ডারের হোজ পাইপের (টিউব) মাধ্যমে সারভো সিলিন্ডারে (servo cylinder) আসে। সারভো সিলিন্ডারের বাকেট এবং পিস্টন তেলের চাপে নড়াচড়া করবে এবং এই নড়াচড়া পুশ রডের মাধ্যমে ক্লাচ ফর্ক রিলিজ বিয়ারিং হয়ে রিলিজ লিভারের উপর বর্তায়। ফলে কয়েল স্প্রিংগুলি সঙ্কুচিত হয় এবং প্রেসার প্লেট ক্লাচ ডিস্ক থেকে অর্ধ ইঞ্চি দূরে সরে আসে। এর ফলশ্রুতি হিসাবে ক্লাচ হয় অর্থাৎ শক্তির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
ক্লাচ সেফটি সুইচ (Clutch safety switch) :
সর্বাধুনিক গাড়িসমূহে এই সুইচের ব্যবহার দেখা যায়। এই সুইচ এমনভাবে কাজ করে যে, ক্লাচ সংযুক্ত (engage) থাকলে তা গাড়িকে চালাতে বিরত রাখে। ক্লাচ প্যাডেলে চাপ দিলে এই সুইচ বন্ধ হয়ে যায় এবং ইগনিশন সুইচ চালু হয়। এই সুইচের উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়ি চালানোর পূর্বে ক্লাচ বিচ্ছিন্ন করতে হয়। তা না হলে গাড়ি চালু হতে না হতেই দ্রুত চলতে আরম্ভ করবে। এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
ক্লাচ ইউনিটে কি কি যন্ত্রাদি মেরামত ও পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়:
নিম্নলিখিত যন্ত্রাংশ পরিষ্কার ও মেরামত করার প্রয়োজন হয়। যেমন : ১। ক্লাচ ডিস্ক (ক্লাচ প্লেট, ফ্রিকশনাল প্লেট) এর ফেসিং বা লাইনিং প্রায়ই ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। ফেসিং সাধারণত তামা, পিতল, ফেব্রিক জাতীয় পদার্থ দ্বারা তৈরী হয়। এর একদিকে থাকে ফ্লাই হুইল এবং অন্যদিকে থাকে প্রেসার প্লেট। ফ্লাই হুইল এবং প্রেসার প্লেট উভয়ই ধাতুর তৈরি কিন্তু ক্লাচ ফেসিং ধাতু দ্বারা তৈরি নয়।
গাড়ি চলতে চলতে এবং উভয় ধাতুর ঘর্ষণে ফেসিং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অনেক সময় ফেসিং এত বেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয় যে রিভিটসমূহ বের হয়ে যায় এবং রিভিটসমূহ-ফ্লাই হুইল ও প্লেসার প্লেটকে ক্ষতি করে অর্থাৎ ফ্লাই হুইল ও প্রেসার প্লেটের পৃষ্ঠভাগ কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু বা গর্ত হয়ে যায় :
আবার কখনও কখনও ক্লাচ ফেসিং তাপে বিবর্ণ হয়ে যায়। উপরোক্ত অসুবিধা দেখা দিলে ক্লাচ ভালভাবে কাজ করতে চায় না। এমতাবস্থায় প্রেসার প্লেট এবং ফ্লাই হুইল লেদ মেশিনের সাহায্যে টারনিং করিয়ে নিতে হয় ফলে এর উপরিভাগ মসৃণ হয়। ক্লাচ ফেসিং পরিবর্তন করতে হয় এবং পুরাতন ফেসিং ক্লাচ ডিস্ক থেকে কেটে ফেলতে হয় এবং নূতন ফেসিং পুনরায় রিভিটিং করতে হয়।
ক্লাচ ডিস্কের হাব, টরশনাল স্প্রিং, স্পুনাইল ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সম্পূর্ণ ক্লাচ ডিস্কটি বদলাতে হয়। তেল, মোবিল, গ্রীজ ইত্যাদি লাগলে ক্লাচ পিচ্ছিল হয়। এমতাবস্থায় ক্লাচ ফেসিং পেট্রোল দ্বারা ধুতে হয়। ধোয়ার পর পুনরায় ব্যবহার করা যায়। ক্লাচ ডিস্ক ধুয়ে ভালভাবে শুকানো একান্ত আবশ্যক। শুকানোর পর খড়িমাটি দ্বারা ভালভাবে মাখিয়ে দিলে ভাল হয়। স্ক্রাইবার দ্বারা মাঝে মাঝে দাগ কেটে দিলে আরও ভাল হয়।
সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যেন ক্লাচ ডিস্কে (ফেসিং) কোন প্রকারে তেল, গ্রীজ ইত্যাদি না লাগে। লাগলে ক্লাচ ভাল হবে না, গাড়ীর দ্রুতি কমে যাবে। গাড়ীর শক্তি নষ্ট হবে এবং ইঞ্জিন গরম হবে। ইঞ্জিন অয়েল সীল এবং থ্রাস্ট ওয়াসার ভালভাবে কাজ না করলে ইঞ্জিন থেকে লুব অয়েল ছিদ্র হয়ে ক্লাচ ফেসিং তৈলাক্ত করে ফেলে। ফলে ক্লাচ ঠিক থাকা সত্ত্বেও ভালভাবে কাজ করতে পারে না। এমতাবস্থায় অয়েল সীল এবং থ্রাস্ট ওয়াসার ও মেইন অয়েল সীল পাল্টানো একান্ত আবশ্যক।
রিলিজ বিয়ারিং বন্ধ হলে ক্লাচ করতে কষ্টসাধা হয়। ইঞ্জিন সুষ্ঠুভাবে শক্তি সরবরাহ করতে পারে না এবং রিলিজ বিয়ারিং মেরামত করা যায় না। ইহা নষ্ট হলে পরিবর্তন করতে হয়। রিলিজ বিয়ারিং-এ মাঝে মধ্যে গ্রীজিং করতে হয়। অনেক রিলিজ বিয়ারিং আছে যা গ্রীজিং করা যায় না। নূতন অবস্থায় যে গ্রীজ থাকে, নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ঐ গ্রীজ দ্বারাই চলে।
ক্লাচ ফর্ক, রিলিজ লিভার, ক্লাচ লিংকেজ, স্প্রিং ইত্যাদি ঠিক আছে কিনা তা মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। যদি ঠিক না থাকে তবে অবস্থাভেদে মেরামত বা পরিবর্তন করতে হয়।
ক্লাচ ইউনিটে দুইটি সংযোগের প্রয়োজন হয় একটি ক্লাচ সংযোগ অর্থাৎ কভার প্লেটের উপরে (এডজাস্টিং ক্রু বা নাট–এর সাহায্যে) এবং অন্যটি ক্লাচ প্যাডেলে। ক্লাচ সংযোগ ঠিক না থাকলে গাড়ী ক্লাচ করা, গিয়ার পরিবর্তন এবং ব্রেক করার সময় অসুবিধা হয়। ক্লাচের এই অবস্থা দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই ক্লাচ সমন্বয় করানো ভাল। অনেক সময় দেখা যায় ক্লাচ সমন্বয় না থাকার জন্য ক্লাচ ফেসিং শীঘ্র নষ্ট হয়ে যায়।
হাইড্রলিক ক্লাচ হলে রিজার্ভ ট্যাঙ্কের তেল আছে কিনা তা প্রতিনিয়তই পরীক্ষা করতে হয়। কারণ তেল না থাকলে ক্লাচ হবে না। তাই গাড়ী চালনা করা দুরূহ ব্যাপার হবে।
তেল (ব্রেক অয়েল) না থাকলে তেল পূর্ণ করে দিতে হয়। হাইড্রলিক ক্লাচ পদ্ধতিতে সাধারণত বাকেট, পিস্টন, সিলিন্ডার, হোজ পাইপ প্রায়ই নষ্ট হয়। বাকেট লিক করলে উহা মেরামত করা যায় না বরং নূতন ক্রয় করে লাগাতে হয়। পিস্টন সামান্য মরিচা ধরলে বা ময়লা হলে এমারী কাপড় দিয়ে ঘর্ষণ করে পরে ধূয়ে ব্যবহার করা যায়।
মাস্টার সিলিন্ডার ওয়াল সামান্য অমসৃণ হলে, ময়লা পড়লে অথবা মরিচা ধরলে এমারী কাপড়ের সাহায্যে ডান হাতের দুই বা তিন আঙ্গুল দ্বারা এপাশ-ওপাশ করে সিলিন্ডারটি কয়েকবার ঘর্ষণ করে মসৃণ করে দিতে হয়। এরপর ভালভাবে ধুয়ে নূতন বাকেট ব্যবহার করে চালনা করা যায়।
মাস্টার সিলিন্ডার এবং পিস্টন যদি খুব বেশী অমসৃণ হয়, গর্ত হয় এবং সাধারণভাবে যদি দেখতে গঠনমুখী না হয় তা হলে পরিবর্তন করা উচিত। হাইড্রলিক ক্লাচে উন্নতমানের অয়েল (ব্রেক অয়েল) ব্যবহার করতে হবে। কখনও অন্য কোন তেল মিশ্রিত করা চলবে না। অন্যথায় বাকেট, পিস্টন, সিলিন্ডার ইত্যাদি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে।
ক্লাচের ফ্রি-প্লে বলতে কি বোঝায়:
রিলিজ বিয়ারিং এবং রিলিজ লিভার-এঁর মধ্যে যে ফাঁক রাখা হয় তাকেই ফ্রি-প্লে বলে। প্রেসার প্লেট যাতে ভালভাবে ক্লাচ ডিস্ককে ফ্লাই হুইলের সাথে চাপযুক্ত করে রাখতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই ক্লাচে ফ্রি-প্লে রাখা হয়। ক্লাচে ফ্রি প্লে না থাকলে ক্লাচ দুর্বল হয় এবং ক্লাচ লাইনিং তাড়াতাড়ি জ্বলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইজন্য বিনা প্রয়োজনে ক্লাচ প্যাডেলে পা রাখা উচিত নয়। ক্লাচ ফ্রি-প্লের পরিমাণ সাধারণত ১ হতে ১ রাখা হয়। ক্লাচ লিংকেজের দৈর্ঘ্য কমবেশী করে ক্লাচ ফ্রি-প্লের সমন্বয় করতে হয়।
ক্লাচ-ফ্রি-প্লে যাতে কমবেশী না হয় সেজন্য কিছুদিন পর পর পরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। গাড়ী চলতে চলতে ক্লাচ এবং অন্যান্য অংশসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্লে বেড়ে যায়। ক্লাচ দীর্ঘদিন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ফ্রি-প্লের প্রতি যথেষ্ট নজর দিতে হয়।
ক্লাচ রিলিজ লিভার সমন্বয় করার নিয়ম :
ফ্লাই হুইল থেকে প্রতিটি রিলিজ লিভারের উচ্চতা সমান রাখাই এই সমন্বয়ের উদ্দেশ্য। যদি রিলিজ লিভারসমূহ একই সময় রিলিজ বিয়ারিং এর সাথে সংযুক্ত না হয়, অর্থাৎ কোটা একটু আগে আবার কোনটা একটু
পরে সংযুক্ত হয়, তাহলে প্রেসার প্লেট ক্লাচ ডিস্ককে (ক্লাচ প্লেটকে) সমভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। ফলে ক্লাচ ফেসিং তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে, ক্লাচ ভাল হবে না এবং গাড়ীর স্বাভাবিক চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হবে। ক্লাচ আই–বোল্ট, নাট অথবা রিলিজ লিভার অ্যাডজাস্টিং স্ক্রুর সাহায্যে এই লিভারের সমতা আনয়ন করা সম্ভব। অর্থাৎ এই লিভারের উচ্চতা কমানো বা বাড়ানো যায়।
আরও দেখুনঃ
- মোটরযানসমূহ রেজিস্ট্রিকরণ
- মোটর গাড়ীর অয়েল লেভেল ইনডিকেটর
- লুবরিকেটিং পাম্পের বিভিন্ন অংশের নাম
- মোটর গাড়ীর লুবরিকেটিং পদ্ধতি
- মোটর গাড়ীর বিভিন্ন পদ্ধতি
- মোটরগাড়ি শিল্প
2 thoughts on “ক্লাচের প্রকারভেদ”