আজকের আলোচনার বিষয়—ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের পরিচিতি। এই পাঠটি “অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের একটি মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একটি ইঞ্জিন বিভিন্ন যান্ত্রিক ও তাপগতীয় প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে শক্তি উৎপন্ন করে, যা যানবাহন চালনার জন্য অপরিহার্য। এই শক্তি উৎপাদন, রূপান্তর ও স্থানান্তরের প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রাংশ নিরবিচারে কাজ করে থাকে।
ইঞ্জিনের প্রতিটি যন্ত্রাংশের রয়েছে নির্দিষ্ট কাজ, গঠন ও কার্যপদ্ধতি। যেমন—সিলিন্ডার ব্লক, পিস্টন, ক্র্যাঙ্কশ্যাফট, ক্যামশ্যাফট, ভালভ, ফ্লাইহুইল ইত্যাদি। এদের সম্মিলিত কার্যপ্রক্রিয়ায় ইঞ্জিন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে এবং গাড়িকে গতিশীল রাখে।
এই পাঠে আমরা ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করব, যা ইঞ্জিনের গঠন, কার্যপদ্ধতি ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সম্যক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ছাত্র-ছাত্রী ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় অধ্যায়।
ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের পরিচিতি
ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের পরিচিতি :
নিম্নে ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রের নাম, কাজ ও অবস্থানের বর্ণনা দেয়া হলো।
১. ক্র্যাঙ্কশ্যাফট (CRANKSHAFT):
ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট একটি ইঞ্জিনের একটি যান্ত্রিক উপাদান যা পিস্টনের পারস্পরিক গতিকে ঘূর্ণন গতিতে রূপান্তর করে। এটি সাধারণত সিলিন্ডারের নীচে অবস্থিত এবং সংযোগকারী রডগুলির মাধ্যমে পিস্টনের সাথে সংযুক্ত থাকে। দহনের কারণে পিস্টনগুলি উপরে এবং নীচে সরে যাওয়ার সাথে সাথে তারা তাদের রৈখিক গতি ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টে স্থানান্তর করে, যা পরে ঘোরে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টের ঘূর্ণনই শেষ পর্যন্ত গাড়ির চাকাকে চালিত করে বা অন্য যন্ত্রপাতিকে শক্তি দেয়।
Crankshaft এক প্রকারের শ্যাফট যা ক্র্যাঙ্ক মেকানিজম দ্বারা পরিচালিত হয়। একটি ক্র্যাঙ্ক এবং ক্র্যাঙ্কপিন সিরিজে রডের সাথে যুক্ত হয়ে ইঞ্জিনের সাথে যুক্ত থাকে। এটা একটি মেকানিক্যাল অংশ যা রেসিপ্রকেটিং মোশনকে রোটেশনাল মোশনে পরিবর্তন করে এবং ফ্লাইহুইল ঘুরায় এবং গাড়িকে চলতে সাহায্য করে। রেসিপ্রকেটিং ইঞ্জিনে Crankshaft ছাড়া গাড়ি চলতে পারে না।
Crankshaft হচ্ছে কম্বাশন ইঞ্জিনের মেরুদন্ড। Crankshaft অধিক শক্তিশালী এবং মজবুত হওয়া খুবই প্রয়োজনীয় যেন এটা দির্ঘস্থায়ী হয়। কম এবং মিডিয়াম গতির ইঞ্জিনের জন্য Crankshaft তোইরির ম্যাটেরিয়াল গুলো হচ্ছেঃ লো এলয় কার্বন স্টিল।
এটা সাধারণত শক্ত ধাতু দ্বারা ঢালাই করা হয়। এটাকে গাড়ীর হৃৎপিণ্ড বলা হয়। এটা সিলিন্ডার ব্লকের ক্র্যাঙ্ককেসিং এর মধ্যে অবস্থান করে এবং কয়েকটি মেইন বিয়ারিং দ্বারা জারনালকে কেসিং এর সাথে রাখা হয় এবং ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের ক্র্যাঙ্কপিনগুলি কানেকটিং রড-এর বিগ এন্ড বিয়ারিং এর সাথে সংযুক্ত থাকে।
পিস্টনের উপর যখন শক্তি উৎপন্ন হয় তখন ঐ শক্তি পিস্টন হতে কানেকটিং রডের সাহায্যে ক্র্যাঙ্কশ্যাফটে আসে। ফলে ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের এই শক্তি বিভিন্ন ইউনিটের মাধ্যমে চাকায় যায়। এর মধ্যে রাইফেল ড্রিল থাকে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের পশ্চাৎভাগে ফ্লাইহুইল সংযুক্ত থাকে।
সম্মুখভাগে গিয়ার বা স্প্রোকেট থাকে যা দ্বারা ক্যামশ্যাফট পরিচালিত হয়ে থাকে। এটা ব্যতীত ভাইব্রেশন ড্যাম্পার এবং ফ্যানবেল্টগুলি ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের সম্মুখ ভাগে সংযুক্ত থাকে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের পশ্চাৎভাগে রিয়ার মেইন বিয়ারিং এবং সম্মুখে ফ্রন্ট মেইন বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়। এছাড়া থ্রাস্ট বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।
মুলত তিন প্রকারের Cranks ইঞ্জিনে ব্যবহার হয়:
Cast Cranks:
এই ধরনের ক্র্যাঙ্ক দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে এবং প্রচুর পরিমানে ডিজেল এবং পেট্রোল ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়। এদের নামকরন করার কারন এই ক্র্যাঙ্ক তৈরি করতে Malleable iron ব্যবহার করা হয় কাস্টিং করে। Cast crank তোইরিতে সস্তা এবং ভাল কাজ করায় ম্যানুফ্যাকচারেরদের একমাত্র পছন্দ।
Forged Cranks:
Forged crank হচ্ছে Cast crank এর চেয়ে বেশী শক্তিশালী। এই crank গুলো সাধারনত শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলোতে ব্যবহার হয় এবং স্ট্যান্ডারভাবে 16V Engine ইঞ্জিনের সাথে আসে। Forged crank সম্পুর্ন আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। এক গুচ্ছ ডাইসের সেট মেশিনিং করা হয় ক্র্যাঙ্ক এর সাইজ অনুযায়ী। এই ডাইগুলো বিশালাকার হাইড্রোলিক প্রেসে বসানো হয় এবং অনেক টন বল প্রয়োগ করা হয়। হাইগ্রেডের স্টীল এলয় বটম ডাই এ স্থাপন করা হয় এবং চাপ দেওয়া হয়। যখন ডাই চাপ দেওয়া হয় তখন বদ্ধ মেটাল খুব টাইটভাবে ডাই এ ঢুকে যায়। এতে কাস্টিং এর চেয়ে সবচেয়ে বেশি সুক্ষ এবং শক্ত হয় ইন্ডাকশন হার্ডেনিং এর কারনে।
Billet Cranks:
Billet crank হচ্ছে সর্বাপেক্ষা ভাল crank যদি আপনি ইঞ্জিন থেকে সবচেয়ে ভাল কিছু আশা করেন। ৪৩৪০ স্টিল ব্যবহার করা হয় এটি তৈরি করতে। ৪৩৪০ স্টিল নিকেল, ক্রোমিয়াম, এলুমিনিয়াম এবং মলিবডেনাম এবং অনান্য উপাদান দিয়ে তৈরি। সবচেয়ে কম crankshaft মেশিনিং টাইমের এর জন্য এটা সবচেয়ে জনপ্রিয়।
Crankshaft এর Construction এর জন্য নিম্নোক্ত ম্যাটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করা হয়:
- Carbon Steel
- Cast iron
- Vanadium micro-alloyed steel
- Forged steel
ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের উপাদান (Components of crankshafts):
- Crankpin
- Main journal
- Crank web
- Counter weights
- Oil passage
- Flywheel mounting flange
২. ক্যামশ্যাফট (CAMSHAFT):
ক্যামশ্যাফ্ট হল একটি ঘূর্ণমান শ্যাফ্ট যার দৈর্ঘ্য বরাবর মাউন্ট করা হয়, যা ক্যাম নামে পরিচিত। এটি পিস্টনের গতির সাথে সুসংগতভাবে একটি ইঞ্জিনের গ্রহণ এবং নিষ্কাশন ভালভ পরিচালনার জন্য দায়ী। ক্যামশ্যাফ্টটি ঘোরার সাথে সাথে, লবগুলি ভালভ উত্তোলক বা রকার বাহুগুলির বিরুদ্ধে ধাক্কা দেয়, যার ফলে সুনির্দিষ্ট সময়ে ভালভগুলি খোলা এবং বন্ধ হয়। ক্যামশ্যাফ্টের নকশা এবং সময় নির্ধারণ করে যে এই ভালভগুলি কখন খোলা এবং বন্ধ হয়, ইঞ্জিনের কার্যকারিতা, জ্বালানী দক্ষতা এবং নির্গমনকে প্রভাবিত করে।
এই শ্যাফট ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের অর্ধেক ঘোরে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফট দুইবার ঘুরলে এটা একবার ঘোরে। এর বিভিন্ন কোণে কতকগুলি লতি (lobe) থাকে। এই লতি ভাল্ভগুলি খুলতে এবং বন্ধ করতে সাহায্য করে। ইসেনট্রিক ক্যামের প্রধান কাজ হচ্ছে এ.সি. পাম্প চালনা করা। ক্যামশ্যাফট প্রধানত চারটি কাজ করে, (ক) ভাল্ভগুলি খোলা এবং বন্ধ করা, (খ) এ.সি পাম্প চালনা করা, (গ) লুব অয়েল পাম্প চালনা করা,
(ঘ) ডিস্ট্রিবিউটর শ্যাফট চালনা করা (গিয়ারের সাহায্যে)। ক্যামশ্যাফটের গিয়ার এবং ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের গিয়ার সরাসরি গিয়ার সংযোগ অথবা চেইন দ্বারা যুক্ত থাকে। ক্যামশ্যাফটের গিয়ার ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের গিয়ার হতে দুই গুণ বড়।
৩. ভাল্ভ (VALVES):
ভাল্ভ দুই রকম— ইনটেক এবং একজস্ট ভালভ। ইনটেক এবং একজস্ট পার্টগুলি খোলা এবং বন্ধ করাই ভাল্ভ এর কাজ। মসরুম এবং পপেট ভাল্ভ বেশীরভাগ ব্যবহার করা হয়। ভালভ উঠানামার জন্য ভাল্ভ স্প্রিং, রকার আর্ম, পুশ রড এবং ভালভ লিফটার ব্যবহার করা হয়।
৪. পিস্টন ও পিস্টন রিং (PISTON):
প্রতিটি সিলিন্ডারে একটি করে পিস্টন থাকে। এটা দেখতে অনেকটা ফাপা গোলাকার কোঁটার মত। পিস্টনে দুই ধরনের রিং থাকে, (ক) এয়ার কম্প্রেশন রিং, (খ) অয়েল কন্ট্রোল রিং। অয়েল রিং এর কাজ হচ্ছে পিস্টনকে সিলিন্ডারের মধ্যে ভালভাবে উঠানামা করার সুবিধার্থে পিস্টন তৈলাক্ত করে রাখা।
কম্প্রেশন রিং এর কাজ হচ্ছে কম্প্রেশন স্ট্রোকে বাতাস যাতে সিলিন্ডার থেকে বের হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এই রিংগুলিতে কোন কাটা বা ফাঁক থাকে না। অয়েল রিংগুলি কাটা বা ফাঁক থাকে এবং সেখানে তেল থাকে।
পিস্টন চার প্রকার যথা—(ক) ক্রাউন পিস্টন, (খ) কনকেভ পিস্টন, (গ) ফ্লাট পিস্টন, (ঘ) বেভেল পিস্টন।
৫. কানেকটিং রড (Connecting rod) :
এটা একটি বিশেষ ধরনের রড। এর দুইটি প্রান্তে দুইটি বিয়ারিং আছে, যেমন—রড প্রান্ত (big end) বিয়ারিং এবং ছোট প্রান্ত (small end) বিয়ারিং। বড় প্রান্ত বিয়ারিং এর সাহায্যে এই রড ক্র্যাঙ্কপিন-এর সাথে যুক্ত।
ছোট প্রান্ত বিয়ারিং পিস্টন পিন বা রিস্ট পিনের সাহায্যে কানেকটিং রডের অন্য প্রান্তকে পিস্টনের সাথে সংযুক্ত করে রাখে। পাওয়ার স্ট্রোকে পিস্টনের উপর যে প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হয় সেই শক্তি ক্র্যাঙ্কশ্যাফটে পৌঁছানোই এই রডের প্রধান কাজ। এই রডের সাহায্যেই পিস্টন সিলিন্ডারের মধ্যে উপরে-নীচে উঠানামা করে কিন্তু ক্র্যাঙ্কশ্যাফট চক্রাকারে ঘোরে।
৬. সিলিন্ডার হেড (CYLINDER HEAD):
এটা সিলিন্ডার বুকের উপর অবস্থান করে। ফে সিলিন্ডারগুলি এর দ্বারা আবৃত থাকে। এটা সিলিন্ডার ব্লকের সাথে স্টাড (stud) দ্বারা সংযুক্ত থাকে। সিলিন্ডার হেড ও সিলিন্ডার ব্লকের মধ্যে হেড গ্যাসকেট ব্যবহার করা হয়।
এটা সাধারণত কাস্ট আয়রন, লৌহ সঙ্কর ধাতু, এলুমিনিয়াম সঙ্কর ধাতু দ্বারা তৈরী হয়। এলুমিনিয়াম দ্বারা তৈরী ইঞ্জিন হেড দ্রুত উত্তাপ কমাতে পারে এবং ওজনেও হালকা। সিলিন্ডার হেডে পানির জ্যাকেট, স্পার্ক প্লাগের ছিদ্র, ভালভ ভালভসিট, দহন প্রকোষ্ঠ ইত্যাদি অবস্থান করে। চিত্র ২,১৪-তে সিলিন্ডার হেড দেখানো হয়েছে।
৭. সিলিন্ডার ব্লক (BLOCK):
সিলিন্ডার ব্লক এবং ক্র্যাঙ্ককেসকে ইঞ্জিনের মেরুদণ্ড বলে। কোন = কোন ইঞ্জিনে এই দুইটি অংশ একসাথে ঢালাই করা থাকে। আবার পৃথক পৃথকও থাকে। বুকের মধ্যে সিলিন্ডারগুলি এবং পানির জ্যাকেটসমূহ অবস্থান করে।
এটা সাধারণত কাস্ট আয়রন, লৌহ সঙ্কর ধাতু, অ্যালুমিনিয়াম সঙ্কর ধাতু দ্বারা ঢালাই করা। অধিকাংশ ইঞ্জিনের সিলিন্ডারগুলি কাস্ট আয়রন দ্বারা তৈরী করা হয়। তবে কোন কোন ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের ওয়ালকে ক্রোনিয়াম ভেনাডিয়াম ইত্যাদি ধাতব পদার্থ দ্বারা পলিশ করিয়া দেওয়া হয়, যাহাতে ওয়াল কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কোন কোন সিলিন্ডারে লাইনার বসানো থাকে। লাইনার ক্ষয়প্রাপ্ত হলে পরিবর্তন করে নূতন লাইনার বসানো যায়। সিলিন্ডার ব্লক বুশ বিয়ারিং এর সাহায্যে ক্যামশ্যাফটকে ধারণ করে। টাইমিং গিয়ার বা চেইন কভার ক্লাচ হাউজিং, ইগনিশন ডিস্ট্রিবিউটর, ফুয়েল পাম্প, অয়েল পাম্প ইত্যাদি ব্লকে ধারণ করে ।
৮. ফ্লাইহুইল (FLYWHEEL):
এই হুইল একটি ভারী গোলাকার চাকার মত। এটা ইঞ্জিনের পশ্চাৎভাগে ফ্র্যাঙ্কশ্যাফটের সাথে সংযুক্ত থাকে। এর চতুর্দিকে একটি রিং গিয়ার লাগানো থাকে। ক্র্যাঙ্কিং মোটর (cranking motor) দ্বারা ইঞ্জিন চালাতে এই রিং গিয়ারটি সহায়তা করে। ফ্লাইহুইল শক্তির সমতা রক্ষা করে। এর সহায়তায় ক্লাচের মাধ্যমে ইঞ্জিন শক্তি ট্রান্সমিশনে (gear box) যায়। যখন গাড়ী চলতে থাকে তখন ক্লাচ ডিক্স ফ্লাই হইলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে ইঞ্জিনে সিলিন্ডারের সংখ্যা কম সেই ইঞ্জিনের ফ্লাইহুইল বড় হয়। যেসব ইঞ্জিনে সিলিন্ডারের সংখ্যা বেশী সে সব ইঞ্জিনে ফ্লাইহুইল ছোট হয়। এটা সাধারণত লৌহনির্মিত হয়।
৯. অয়েল প্যান (Oil Sump (Oil Pan / Oil Tray / Oil Reservoir)) :
এটি অয়েল সাম্প (sump) নামেও পরিচিত। এটি একটি পাত্র বিশেষ। এটি ইঞ্জিনের লুবরিকেটিং অয়েল ধারণ করে। এই প্যান সাধারণত স্টীল শিটে তৈরী হয়। ক্র্যাঙ্ককেসের নীচে এর অবস্থান। এটা স্ক্রু অথবা বোল্ট (bolts)-এর সাহায্যে ক্র্যাঙ্ককেসের সাথে যুক্ত থাকে।
লুবরিকেটিং পদ্ধতির পাম্প, ছাঁকনি (strainer) ইত্যাদি অয়েল প্যানের মধ্যে বিরাজ করে। এই প্যানের নীচের দিকে একটি ড্রেন প্লাগ (কক) থাকে। এর সাহায্যে লুব অয়েল (খারাপ হলে) বের করে ফেলা যায়। কোন কোন অয়েল প্যানে চুম্বক থাকে। তেলে কোন লোহা জাতীয় পদার্থ থাকলে তা আকর্ষণ করে এবং ইঞ্জিনকে বিপদমুক্ত রাখে ।
১০. ম্যানিফোল্ড (Manifold):
ইঞ্জিনে দুই ধরনের মেনিফোল্ড ব্যবহার করা হয়। যেমন : (ক) ইনটেক মেনিফোল্ড (খ) একজস্ট মেনিফোল্ড। (ক) ইনটেক মেনিফোল্ড : এটা ফাঁপা আঁকাবাঁকা (মোটা) টিউব আকৃতিবিশিষ্ট। এটা কাস্ট আয়রন দ্বারা ঢালাই করে তৈরী করা হয়।
কারবুরেটর হতে এয়ার ফুয়েল মিশ্রিত হয়ে ইনটেক মেনিফোল্ডের মাধ্যমে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। এর উপর দুইটি কারবুরেটর মাউন্টিং বোল্ট থাকে। সেখানে কারবুরেটর বসানো হয়। প্রতিটি সিলিন্ডারের সাথে ইনটেক মেনিফোল্ডের সংযোগ থাকে। ডিজেল ইঞ্জিন হলে শুধুমাত্র বাতাস ইনটেক মেনিফোল্ডের মাধ্যমে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। এর সাথে এয়ার ক্লিনার সংযুক্ত থাকে।
(খ) একজস্ট মেনিফোল্ড : এটাও অনেকটা ইনটেক মেনিফোল্ডের মত। এটা দ্বারা ইঞ্জিনের পোড়া গ্যাস বের হয়। এই মেনিফোল্ডের সাথে সাইলেন্সার বক্স এবং টেইল পাইপ যুক্ত থাকে। প্রতিটি সিলিন্ডারের সাথে উক্ত মেনিফোল্ডের সংযোগ থাকে। একজস্ট এবং ইনটেক মেনিফোল্ড একই সাথে অবস্থান করে। উপরে থাকে ইনটেক মেনিফোল্ড এবং নীচে থাকে একজস্ট মেনিফোল্ড।
১১. ক্র্যাঙ্ককেস (Crankcase):
এটি সিলিন্ডার ব্লকের সাথে কাস্টিং করা থাকে অথবা বোল্ট দ্বারা আটকানো থাকে। সিলিন্ডার ব্লকের নীচের অংশকে ক্র্যাঙ্ককেস বলে। ক্র্যাঙ্ককেসের ফাঁকা অংশ ক্র্যাঙ্কশ্যাফট ঘোরে।
১২. পিস্টন পিন (Gudgeon Pin (Wrist Pin / Piston Pin)):
এই পিনের অন্য নাম আছে, যেমন : গাজন পিন (Gudgeon ২”-৩” পর্যন্ত হয়। pin), রিস্ট পিন (wrist pin), ফাঁপা গোলাকার এবং লম্বায় ২”-৩ ক্ষেত্রবিশেষে ছোট-বড়ও হতে পারে। কানেকটিং রডের স্মল এন্ড বিয়ারিং এই পিন দ্বারা পিস্টনের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই পিন পিস্টনের সাথে সংযুক্ত করার পর পিনের দুই প্রান্তে দুইটি স্প্রিং লক থাকে যেন পিন বের হতে না পারে ।
১৩. কানেকটিং রড বিয়ারিং (Connecting Rod Bearing):
রডের দুই প্রান্তে দুই ধরনের বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়। যে অংশ পিস্টনের সাথে থাকে সেখানে বুশ টাইপ বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়। কানেকটিং রডের অপর অংশ বিগ এন্ড বিয়ারিং—দুই অংশে বিভক্ত। এক অংশ কানেকটিং রডের সাথে থাকে। অপর অধাংশ ক্যাপ নামে পরিচিত। এই দুই অংশের মধ্যে শেল বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়। ২,১৩ চিত্রে এর গঠন ও কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।
১৪. টাইমিং গিয়ার (Timing Gear):
টাইমিং বলতে বোঝায় ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের সাথে ক্যামশ্যাফটের ঘূর্ণনের অনুপাতকে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফট দুইবার ঘুরলে ক্যামশ্যাফট একবার ঘুরবে, এটাই নিয়ম। ক্র্যাঙ্কশ্যাফট স্প্রোকেটে যদি ১৯টি দাত থাকে তবে ক্যামশ্যাফট স্প্রোকেটের ৩৮টি দাত থাকবে। তাহলে ক্র্যাঙ্কশ্যাফট দুইবার ঘুরলে ক্যামশ্যাফট একবার ঘুরবে। এই দুইটি স্প্রোকেট বা গিয়ার দুইটি কোন কোন ইঞ্জিনে সরাসরি যুক্ত করা থাকে বা দাতে দাঁতে মিশানো থাকে।
আবার অনেক ইঞ্জিনে এই দুইটি গিয়ার চেইন দ্বারা সংযুক্ত করা থাকে। এই গিয়ার দুইটিতেই ভাল্ভ টাইমিং চিহ্ন থাকে এবং চেইনটিতেও টাইমিং চিহ্ন থাকে। এই চিহ্নগুলির সাহায্যে ইঞ্জিন ভাল্ভ টাইমিং অতি সহজে করা যায়। ২.১৬ (ক) চিত্রে ভাল্ভ টাইমিং এবং ভাল্ভ টাইমিং চিহ্ন দেখানো হয়েছে।
১৫. গ্যাসকেট (Gasket) :
ইঞ্জিনের কিছু কিছু প্রয়োজনীয় অংশ একটির সঙ্গে অন্যটি সংযুক্ত করবার সময় দুইটি অংশের মধ্যে যা ব্যবহার করা হয় তাকে গ্যাসকেট বলে।
এটা প্যাকিং পেপার, কর্কশীট ইত্যাদি দিয়ে তৈরী হয়। কোন কোন গ্যাসকেটের উপরিভাগে খুব পাতলা করে ধাতুর আবরণ দেওয়া থাকে। যেমন ইঞ্জিন হেড গ্যাসকেট থাকে। গ্যাসকেট ব্যবহারে দুই অংশের সংযুক্তিকরণ মজবুত হয়, ছিদ্র বন্ধ হয় এবং ক্ষয় কম হয়।
১৬. সুপারচার্জার (Supercharger):
যে কৌশলের (device) সাহায্যে অধিক পরিমাণ বাতাস ইঞ্জিনের কার্যকরী সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো যায় তাকে সুপারচার্জার বলে। সুপারচার্জার দুই প্রকার, যেমন : (ক) মেকানিক্যাল সুপারচার্জার, (খ) একজস্ট গ্যাস সুপারচার্জার।
একজস্ট গ্যাসের চাপে চালিত হয় বলে এই জাতীয় সুপারচার্জারকে টারবোচার্জার বলে। টারবোচার্জারে ড্রাইভিং এবং সাকশন ইম্পেলার থাকে। একজস্ট গ্যাসের চাপে চালিত হয়ে সাকশন ইম্পেলার বাতাসকে টেনে চাপে সরবরাহ করে। চাপযুক্ত বাতাস ইনলেট মেনিফোল্ড এবং ইনলেট ভাল্ভ হয়ে সিলিন্ডারে যায়। কোন কোন ইঞ্জিনে অধিক শক্তি উৎপন্ন করার জন্য টারবোচার্জারের দেয়া বাতাস এয়ারকুলারে ঠাণ্ডা করানোর পর সিলিন্ডারে দেওয়া হয়। ফলে সিলিন্ডারে বাতাসের ওজন বেড়ে যায় এবং বেশী জ্বালানি দহন করতে পারে।
বেশী উচ্চতায় (পাহাড়ী এলাকায়) বাতাস হালকা হয়ে যায়, ফলে চাপও কমে যায়। তাই বেশী উচ্চতায় ইঞ্জিনের শক্তি কমে যায়। হালকা ও চাপ কম হওয়ার দরুন জ্বালানি সম্পূর্ণভাবে দহন হতে পারে না। বেশী উচ্চতায় শক্তির তারতম্য রোধের জন্য সুপারচার্জার ব্যবহার করা হয়।
১৭. কার্বুরেটর (Carburetor):
কার্বুরেটর এমন একটি যন্ত্র যা একটি সিস্টেমের দাহ্য বায়ু জ্বালানির মিশ্রণ প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। একে অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের হৃৎপিণ্ড বলা হয়। এটি শুধুমাত্র পেট্রোল ইঞ্জিনে পাওয়া যায়। এটি অটোমোবাইল ইঞ্জিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত।
নিম্নলিখিত অংশগুলি নিয়ে একটি সাধারণ কার্বুরেটর গঠিতঃ
- থ্রোটল ভাল্ব : এখানে থ্রোটল ভাল্ব প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। জ্বালানি বায়ুর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
- ভেন্চুরি : ভেন্চুরি হলো এক ধরনের ফাঁকা টিউব যার প্রস্থ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। মূলত চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- স্ট্রেইনার : এটি ছাঁকনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি থেকে ধূলিকণা অপসারণ করাই এর প্রধান কাজ।
- ফ্লোট চেম্বার : একে জ্বালানি সংরক্ষণের আধার বলা হয়। ট্যাঙ্ক ফাঁকা থাকলে ভাল্ব খুলে যায় এবং ভর্তি হলে ভাল্ব বন্ধ হয়ে যায়।
- মিক্সিং চেম্বার : এখানে জ্বালানি এবং বায়ুর মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর সিলিন্ডারে পাঠানো হয়।
- মিটারিং ব্যবস্থা : এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্গমনের অগ্রভাগ দিয়ে জ্বালানির বের হয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- চোক ভাল্ব : প্রধানত,এটি মিক্সিং চেম্বারের ভেতরে বাতাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।শীতকালে ইঞ্জিন চালু না হলে এটি ব্যবহার করা হয়।
- নিষ্ক্রিয়করণ ব্যবস্থা : ব্যবস্থাঃ ফ্লোট চেম্বার শুরু করে ভেন্চুরি পর্যন্ত ফাঁকা জায়গাটি নিষ্ক্রিয়করন ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এখানে জ্বালানি বায়ুর মিশ্রণকে নিষ্ক্রিয় করা হয়।
- নিষ্ক্রিয় এবং স্থানান্তর পোর্ট : নিষ্ক্রিয় এবং স্থানান্তর পোর্টে ভেন্চুরির নোজল ছাড়াও আরো দুটি নোজল থাকে যা সিলিন্ডারে জ্বালানি সরবরাহ করে।
কার্বুরেটরের প্রকারভেদঃ
মিশ্রণ সরবরাহের দিক অনুযায়ী কার্বুরেটরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমেঃ
আপ ড্রাফট কার্বুরেটরঃ মিক্সিং চেম্বারের নিচ থেকে বাতাস সরবরাহ করা হলে তাকে আপ ড্রাফট কার্বুরেটর বলে।
ডাউন ড্রাফট কার্বুরেটরঃ যদি মিক্সিং চেম্বারের উপর থেকে বাতাস সরবরাহ করা হয় তাহলে তাকে ডাউন ড্রাফট কার্বুরেটর বলে।
অনুভূমিক কার্বুরেটরঃ যদি মিক্সিং চেম্বারের যেকোনো একপাশ থেকে বাতাস সরবরাহ করা হয় তাহলে তাকে অনুভূমিক কার্বুরেটর বলে।.
কার্বুরেটরের কার্যপ্রণালিঃ
এটি ব্রেইনুলি নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। প্রথমত, থ্রোটল ভাল্ব খুলে যায় জ্বালানির সরবরাহ শুরু হয়। এসময় ফ্লোট চেম্বারে গ্যাসোলিনের স্তর ধ্রুব থাকে। ফ্লোট চেম্বার জ্বালানি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাল্ব বন্ধ হয়ে যায়। বাতাস ভেন্চুরির মাধ্যমে প্রবেশ করার পর দ্রুত বায়ুচাপ সর্বোচ্চ হয়ে যায়। এটা মূলত সাকশন স্ট্রোকের সময় হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে চাপ কমতে থাকে । ফ্লোট চেম্বার এবং ভেন্চুরির মধ্যে চাপের পার্থক্যের কারণে জ্বালানি বায়ুর মিশ্রণ বাতাসে ছেড়ে দেয়। এটি ডিসচার্জ জেট দ্বারা প্রবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট অনুপাতে বায়ু জ্বালানীর মিশ্রণ দিতে সক্ষম।
কার্বুরেটরের ব্যবহারঃ
- স্পার্ক ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়।
- সহজে বায়ু এবং জ্বালানির মিশ্রণ প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়।
- যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রনে ব্যবহার করা হয়।
- সিলিকন- ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়।
- পেট্রোলকে সুক্ষ কণায় রূপান্তর করতে ব্যবহার করা হয়।
কার্বুরেটরের কিছু সুবিধা:
- ফুয়েল ইনজেকটরের চেয়ে অনেক বেশি সস্তা।
- অতিরিক্ত বায়ু জ্বালানির মিশ্রণ পাওয়া যায়।
- সিলিন্ডার কার্বুরেটরের মাধ্যমে বেশি জ্বালানি টানতে পারে।
- সহজে মেরামত করা যায়।।
- দুই স্ট্রোক এবং চার স্ট্রোক উভয়ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
কার্বুরেটরের কিছু অসুবিধা:
- মিশ্রণ সরবরাহের গতি বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত কিছু ব্যবস্থার প্রয়োজন।
- পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
- ফুয়েল ইনজেকটরের চেয়ে ভারী।
- কার্বুরেটর চালু রাখতে ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেমের চেয়ে বেশি খরচ লাগে।
১৮. মাফলার / সাইলেন্সার (Muffler / Silencer):
মাফলার ( উত্তর আমেরিকান এবং অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি ) বা সাইলেন্সার ( ব্রিটিশ ইংরেজি ) অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের নিষ্কাশন দ্বারা নির্গত শব্দ কমানোর জন্য একটি যন্ত্র। এটা এক ধরণের শব্দ হ্রাস-কারী ডিভাইস যা অটোমোবাইলের নিষ্কাশন সিস্টেমের অংশ।
১৯. স্পার্ক প্লাগ (Spark Plug):
এই ডিভাইসটি একটি বিচ্ছিন্ন ইলেক্ট্রোড ইঞ্জিন সিলিন্ডারের উপরে যুক্ত থাকে এবং ইঞ্জিনকে শক্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্পার্ক তৈরি করতে সাহায্য করে।
২০. গভর্নর (Governor):
গভর্নর এক ধরবের ডিভাইস যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোটারি স্পিড নিয়ন্ত্রণ কারে। একটি সাধারণ গভর্নর একটি ইঞ্জিনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে যে হারে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।
২১. টাইমিং বেল্ট (Timing belt):
টাইমিং বেল্ট (বা ক্যামবেল্ট) বা টাইমিং চেইন বা টাইমিং গিয়ারের সেট পিস্টন ইঞ্জিনের একটি অংশ। এটি একটি পচনশীল উপাদান যা ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট এবং ক্যামশ্যাফ্টের ঘূর্ণনকে সিঙ্ক্রোনাইজ করতে ব্যবহৃত হয়।
আর দেখুনঃ