আংশিক পাতন – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” এর “বাষ্পীয় বয়লার বা জেনারেটর” বিষয়ক পাঠ।
আংশিক পাতন
আধুনিক বিশ্বের বড় বড় তেল শোধনাগারে এই পদ্ধতিতে তেল শোধন করা হয়। আমাদের দেশে চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারীতে আংশিক পাতন টাওয়ারের সাহায্যে অপরিশোধিত তেল শোধন করা হয়। এই পদ্ধতিতে ১০০ ফুট উঁচু ইস্পাতের একটি টাওয়ার থাকে। যার মধ্যে ২ ফুট অন্তর একটি ট্রে থাকে। বিভিন্ন ট্রেতে বিভিন্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে।
তাপমাত্রার বিভিন্নতার জন্য বিভিন্ন ট্রেতে বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ জমা হয়। অপরিশোধিত তেলকে প্রথমে ৬০০ হতে ৭০০° F তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। ফলে তেল বাষ্পে রূপ নেয়। এমতাবস্থায় উক্ত তেলকে আংশিক টাওয়ারে পাঠানো হয়। তাপের তারতম্য অনুসারে এবং তেলের মান অনুসারে বিভিন্ন ট্রেতে জমতে থাকে।
টাওয়ারের সর্বোচ্চ স্থানে জমা হয় প্রকৃতিক গ্যাস। এর তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। তারপর হাইস্পীড পেট্রোল যা বিমানে ব্যবহার করা হয়। তারপর সাধারণ পেট্রোল (মোটরযানের ব্যবহারের জন্য) সাদা কেরোসিন, হাইস্পীড ডিজেল, ডিজেল, ফার্নেস তেল জমা হয়। সর্বশেষ ট্রেগুলিতে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী।
তেলের তলানি (residue)
হতে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পদার্থে রূপ দেওয়া হয়। যেমন : গ্রীজ, লুব অয়েল, আলকাতরা ইত্যাদি।
পেট্রোলের গুণাবলী :
গ্যাসোলিন বা পেট্রোলের নিম্নলিখিত গুণাবলী থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়, যাতে মোটরযান বিভিন্ন কার্যকরী অবস্থায় সন্তোষজনকভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়।
১। বাষ্পীয়ভবন ক্ষমতা
- (i) সহজ স্টার্টিং (eassy starting ),
- (ii) বাষ্পীয় লক (vapour lock),
- (iii) সহজে উত্তপ্ত হওয়া (quick warm-up),
- (iv) সহজ সরল উত্তেজনা (smooth acceleration)
- (v) উত্তম মিতব্যয়ী (good economy)
- (vi) ক্র্যাঙ্ককেস ডাইলুশন (crankcase dilution )
২। ধাক্কা প্রতিহত করার ক্ষমতা (Anti-knock value)।
৩। মরিচা রোধক ক্ষমতা (Corossioness)।
৪। বিশুদ্ধতা (purity)
৫। গাড়ীচালনায় মিতব্যয়িতা (operating economy)
(১) বাষ্পীয়ভবন ক্ষমতা :
পেট্রোলের মধ্যে এমন একটি ক্ষমতা থাকা একান্ত প্রয়োজন যার ফলে পেট্রোল তাড়াতাড়ি বাষ্পে পরিণত হতে পারে এবং অতি কম তাপমাত্রায় জ্বলে যেতে পারে। এই ব্যবস্থা ভাল গাড়ী চালনার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(i) সহজ স্টার্টিং :
পেট্রোলের এমন একটি গুণ থাকা একান্ত দরকার যার ফলে ইঞ্জিনের দহনকার্য অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়। এই গুণের অভাব ঘটলে দহনকার্যে বিঘ্ন ঘটে।
(ii) বাষ্পীয় লক :
পেট্রোলের মধ্যে বাষ্পীয়ভবনের ক্ষমতা বেশী থাকলে ইঞ্জিনের স্বাভাবিক দহনকার্যের জন্য মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাপমাত্রা সামান্যতম বৃদ্ধি হলেই পেট্রোল কারবুরেটরের বর্তনীসমূহে বাষ্পের সৃষ্টি হয়। ফলে স্বাভাবিক তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। তাই পেট্রোলের মধ্যে যাতে বাষ্পীয়ভবন ক্ষমতা কোনক্রমেই বেশী না থাকে সেদিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হয়।
(iii) সহজে উত্তপ্ত হওয়া :
উন্নতমানের পেট্রোল দ্বারা ইঞ্জিন সহজে চালু হয় এবং সহজে উত্তপ্তও হয়। ইঞ্জিন হতে ভাল কার্যকরী শক্তি পাওয়ার জন্য ইঞ্জিন তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হওয়া একান্ত দরকার। বর্তমানে বেশীর ভাগ গাড়ীতে দেখা যায় একজস্ট মেনিফোল্ড এবং ইনটেক মেনিফোল্ড পাশাপাশি রাখা হয়। এর ফলে বাষ্প জ্বালানি মিশ্রণ দ্রুত বাষ্পে রূপ নেয় এবং ইঞ্জিনের দহনকার্য ভাল হয়। অর্থাৎ ইঞ্জিন দ্রুত উত্তপ্ত হয়।
(iv) সহজ সরল উত্তেজনা :
মোটরযান সময় বিশেষে সহসা উত্তেজিত করানো অথবা বেগবান বা ধাবমান করার প্রয়োজন হয়। এই কার্যটি যাতে সহজ সরলভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য জ্বালানি তেলে উত্তম পরিমাণে বাষ্পীয়ভবন ক্ষমতা থাকা একান্ত দরকার। অ্যাকসেলারেটর প্যাডেল সহসা চাপ দিলে অতিরিক্ত অতিরিক্ত তেল সরবরাহ হয়। এই তেল ভালভাবে জ্বলা একান্ত দরকার। তা না হলে ইঞ্জিনের শক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়।
(v) উত্তম মিতব্যয়ী :
মোটরযান মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গতিতে ও অবস্থায় চালিত হয়। তাই এর সাথে ভারসাম্যতা বজায় রাখার জন্য জ্বালানির গুণগত মান এমন হতে হয় যাতে বাষ্পীয়ভবন বেশী না হয়। বাষ্পীয়ভবন বেশী হলে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি পায়। আবার বাষ্পীয়ভবন কম হলে মিশ্রণ দুর্বল হয়ে যায় ফলে ইঞ্জিনের উৎপাদিত শক্তির মাত্রা হ্রাস পায়। তাই জ্বালানি মিতব্যয়ীতার জন্য বাষ্পীয়ভবনের ক্ষমতা মধ্যম থাকা ভাল।
(vi) ক্র্যাঙ্ককেস ডাইলুশন :
এর অর্থ জ্বালানি প্রকোষ্ঠে যে মিশ্রণ প্রবেশ করে এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকাগুলির কিছু অংশ পিস্টন রিং ও সিলিন্ডারের ফাঁক দিয়ে ইঞ্জিন ক্র্যাঙ্ককেসে ঢুকে ক্রমান্বয়ে লুব অয়েলের সাথে মিশ্রিত হয়ে লুব অয়েলকে পাতলা করে দেয়। এটা ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকর। যার ফলে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ দ্রুত ক্ষয় হয় এবং বেশী গরম হয়। জ্বালানি তেলের বাষ্পীয়ভবন ক্ষমতা একটু বেশী হলে ক্র্যাঙ্ককেস ডাইলুশন কম হয়।
(২) ধাক্কা প্রতিহত করার ক্ষমতা (Anti-knock valve) :
জ্বালানি তেল ভাল ভাবে না জ্বললে জ্বালানি প্রকোষ্ঠে কার্বন জমে। ফলে প্রি-ইগনিশন হয়। ইঞ্জিনে প্রি-ইগনিশন হলে নক বা ধাক্কার সৃষ্টি হয় যা ইঞ্জিনের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্ট করে থাকে। ধাক্কা প্রতিহত করার জন্য জ্বালানির সাথে অকটেন মিশাতে হয়।
সাধারণত ৫ গ্যালনের সাথে এক গ্যালন ১০০% অকটেন মিশ্রিত করলে তেলের দহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে তেল ভালভাবে প্রজ্বলিত হয় এবং জ্বালানি প্রকোষ্ঠে কার্বন জমে না এবং ইঞ্জিনের নক বা ধাক্কা কমে যায়।
(৩) মরিচা রোধক ক্ষমতা :
জ্বালানি তেলে এমন কোন ক্ষার জাতীয় পদার্থ থাকা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ উহা ইঞ্জিনের পার্ট সমূহে ক্ষয় এবং মরিচা ধরতে সহায়তা করে। তাই সালফারের অংশ যত কম থাকে ততই মঙ্গল।
(৪) বিশুদ্ধতা :
জ্বালানি তেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া আবশ্যক। তেলে ময়লা, গাদ, পানি, আঁশ ইত্যাদি থাকা বড়ই ক্ষতিকর। এসব ইঞ্জিনের স্বাভাবিক চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়।
(৫) গাড়ী চালনা মিতব্যয়িতা :
মোটরযানের জ্বালানি এমন হওয়া দরকার যেন প্রতি গ্যালনে বেশী মাইল যায়, দহনকার্য ভাল হয়, পরিষ্কার হয়, নকিং সৃষ্টি না করে। মূল্য কম হওয়াও বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা জ্বালানির (পেট্রোলের) বিকল্প উদ্ভাবনের চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে তেলের দাম খুব বেশী হওয়ার দরুন এই বিকল্প প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আরও দেখুনঃ
- ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন করার সাধারণ নিয়ম
- ইঞ্জিন ওভারহলিং এবং ইঞ্জিনের গোলযোগ
- গভর্নর এর ব্যবহার
- সাসপেনশন ও স্টিয়ারিং ব্যবস্থা
- ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি নির্ণয়করণ
- মোটরগাড়ি শিল্প
3 thoughts on “রিফাইনারীতে আংশিক পাতন”