স্টোরেজ ব্যাটারীর সাধারণ নিয়মাবলী নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের ” বৈদ্যুতিক পদ্ধতি” বিভাগের একটি পাঠ।
স্টোরেজ ব্যাটারীর সাধারণ নিয়মাবলী
১। ব্যাটারী বসানোর স্থান সমতল ও ব্যাটা-রীর মাপ অনুযায়ী হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয় ।
২। ব্যাটারীর টার্মিনালসমূহ এবং ব্যাটা-রীর উপরিভাগ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। টার্মিনাল এবং কানেকটর লেডগুলিতে ভেসলিন বা ভাল গ্রীজ লাগাতে হয়।
৩। ব্যাটারীর নেগেটিভ ও পজেটিভ টার্মিনাল পোস্টগুলিতে কানেকটর লেড লাগানোর সময় কোন প্রকারে যেন চেঁছে বা ছিলে না যায় তার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। ভেন্ট প্লাগের ছিদ্র সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ভিতরের গ্যাস তাড়াতাড়ি বের হতে পারে।
৫। ইলেকট্রোলাইট শুকিয়ে গেলে শুধু পানি বা ডিস্টিল্ড ওয়াটার মিশাতে হয়। কোনক্রমেই অ্যাসিড মিশানো উচিত হবে না।
৬। সেলফ স্টার্টার দ্বারা ইঞ্জিন চালানোর সময় কোনক্রমেই ৩০ সেকেন্ডের বেশী ক্র্যাঙ্কিং করতে নেই। বেশী সময় ক্র্যাঙ্কিং করলে ব্যাটারী এবং মোটরের প্রচুর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কারণ ব্যাটারী ও মোটর খুব গরম হয়ে যায়। ঠাণ্ডা করার জন্য কিছু সময় পর পর ক্র্যাঙ্কিং করা উচিত।
৭। সবসময় ইলেকট্রোলাইট দ্বারা প্লেটসমূহ ডুবিয়ে রাখতে হয়। প্লেটের উপরিভাগে যেন ১/২ থেকে — ” ইলেকট্রোলাইট থাকে। প্লেট ভেসে গেলে ব্যাটা-রীর কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং প্লেটসমূহ নষ্ট হয়ে যায়।
৮। সব সময় ব্যাটারীতে চার্জ পূর্ণ করে রাখতে হয়। যে ব্যাটারী দ্বারা কাজ করা হয় না। সেসব ব্যাটারী সপ্তাহে অন্তত একবার চার্জ করে রাখতে হয়।
৯। হাইড্রোমিটার দ্বারা ইলেকট্রোলাইটের আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity) পরিমাপ করা যায়। প্রতি সেলের অবস্থা নিরূপণ করা যায়। ব্যাটারী পূর্ণ চার্জ হলে ১.২৫০ থেকে ১.২৮৩ আপেক্ষিক গুরুত্বসম্পন্ন হবে। ব্যাটারী ডিচার্জ হলে ১.১১০ থেকে ১,১০০ হাইড্রোমিটার রিডিং দেখা যাবে। ব্যাটারী বেশী দিন ডিসচার্জ অবস্থায় ফেলে রাখা উচিত নয়।
১০। ব্যাটারী টার্মিনালের সাথে ব্যাটারী ক্যাবলের সংযোজন খুব শক্তভাবে দিতে হয়।
১১। সালফিউরিক অ্যাসিড ডিস্টিল্ড ওয়াটারের মধ্যে ঢালতে হয়। অ্যাসিডের মধ্যে পানি ঢালতে নেই। এতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা থাকে। পানিতে অ্যাসিড আস্তে আস্তে ঢালতে হয়। পানির সাথে অ্যাসিড মিশালে খুব গরম হয়। যে গ্লাস জারে ইলেকট্রোলাইট তৈরী করা হয় সেটাও গরম হয়। মিশ্রণ ভালভাবে ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত ব্যাটারীতে ঢালা উচিত নয়। কারণ, প্লেট নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১২। ব্যাটারীতে সব সময় অ্যাসিডের ভাগ কম রাখতে হয় এবং ব্যাটারী যত কম অ্যাম্পেয়ার চার্জ করা যায় ব্যাটা-রীর জন্য ততই ভাল। এজন্য ব্যাটা-রীর প্লেট বহুদিন কার্যক্রম থাকে।
১৩। ব্যাটারীতে অ্যাসিড বেশী দিলে বা থাকলে প্লেটসমূহ তাড়াতাড়ি নষ্ট বা শক্ত হয়ে যায়। সেপারেটরগুলিও তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাটা-রীর আয়ুষ্কাল কমে যায়।
১৪। ব্যাটারীর নেগেটিভ ও পজেটিভ ক্যাবলগুলিতে মোটা তার লাগাতে হয় যেন ব্যাটারী থেকে সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে এবং বেশী বিদ্যুৎ যেতে পারে। ক্যাবল (cable) সরু হলে গরম হয়ে পুড়ে যায় এবং সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে না এবং রোধকতা বেড়ে যায়।
১৫। ব্যাটারীতে কখনও অতিরিক্ত (over) চার্জ দিতে নেই। বেশী চার্জ দিলে ব্যাটারীর পানি দ্রুত কমে বা শুকিয়ে যায়। ফলে ব্যাটারীর প্লেট নষ্ট হয় এবং অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার ফলে সেপারেটর নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাটা-রীর অভ্যন্তরীণ শর্ট হয়। কখনও কখনও এক বা একাধিক সেল নষ্ট হয়ে যায়।
১৬। ব্যাটারীকে ওভার চার্জ থেকে রক্ষা করার জন্য ভোল্টেজ রেগুলেটর-এর এয়ার গ্যাপ বাড়িয়ে দিতে হয় অথবা নতুন একটি রোধক সংযোজন করতে হয়। দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখলেও ব্যাটারীকে ওভারচার্জ থেকে রক্ষা করা যায়।
১৭। অনেক সময় দেখা যায় হাইড্রোমিটার দ্বারা পরীক্ষা করলে ব্যাটারী পূর্ণ দেখা যায়। কিন্তু লোড পরীক্ষা করলে বা গাড়ীতে লাগিয়ে ইঞ্জিন চালু করলে দুই চারবার বেশ ভালভাবে চলতে পারে অথবা বেশ কিছুদিন দিনের বেলায় গাড়ী চালাতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু রাতের বেলা হেডলাইট ও অন্যান্য লাইট জ্বালালে ব্যাটারী ইঞ্জিনকে আর চালু করতে পারে না অর্থাৎ বোঝা বহন করতে পারে না। বোঝা পরীক্ষা করে দেখা যায় সেল ভোল্ট বা মোট ভোল্ট ১.৫ এবং ৯.৫ হয়। এর কারণ হচ্ছে ব্যাটারীেেত অ্যাসিড মিশালে প্লেট শক্ত হয়ে যায়। এবং এর ফলে চার্জ ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। প্লেট পুরাতন হলেও এরূপ হতে পারে। অভ্যন্তরীণ শর্টও হতে পারে।
ব্যাটারীতে অতিরিক্ত চার্জ হয়ে গেলে করনীয়:
ব্যাটারী নতুন অবস্থায় এরূপ হলে বুঝতে হবে ব্যাটারীতে অতিরিক্ত চার্জ হয়ে প্লেট শক্ত হয়েছে, যার ফলে চার্জ ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এমতাবস্থায় সব ইলেকট্রোলাইট ফেলে শুধুমাত্র পানি দ্বারা ব্যাটারী চার্জ করলে দেখা যাবে ব্যাটারী আস্তে আস্তে পূর্ণ চার্জের দিকে যাচ্ছে বা হচ্ছে। এভাবে ব্যাটারীটি বেশ কয়েক মাস চালানো যায়। ব্যাটারী নতুন অবস্থায় এরূপ হলে দিনের বেলায় কোন অসুবিধার সৃষ্টি করে না। তবে রাতে বেশী সময় লাইট জ্বালিয়ে রাখলে, রেডিও বাজালে এবং শর্টস্টপ এই প্রক্রিয়ায় গাড়ী চালনা করলে ব্যাটারীতে বেশী চাপের সৃষ্টি হয়। ফলে দ্রুত ব্যাটারী ডিসচার্জ হয়ে যায়। ফলে ঘন ঘন ব্যাটারী চার্জ করতে হয় ।
১৮। শর্টরান, শর্টস্টপ এই প্রক্রিয়াতে গাড়ী চালনা করলে ব্যাটারী তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ডায়নামা বা অলটারনেটর ব্যাটারীকে যতটুকু চার্জ করার সুযোগ পায় ব্যাটারী অ্যাম্পেয়ার তার থেকে বেশী খরচ হয়। তাই গাড়ী দীর্ঘ রাস্তায় চালালে ব্যাটারী অনেক দিন ভাল থাকে।
১৯। হাইড্রোমিটার দ্বারা আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপার সময় ৮০° ফাঃ স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসাবে ধরা হয়। যদি ঐ সময় স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯০° ফাঃ হয় তবে বর্ধিত প্রতি ১০° ফাঃ তাপমাত্রার জন্য প্রাপ্ত আপেক্ষিক গুরুত্বের (specific gravity) সঙ্গে .০০৪ যোগ করতে হয়। আবার যদি স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৮০° ফাঃ হতে কমে যায় তাহলে ১০° ফাঃ তাপমাত্রা কমার জন্য প্রাপ্ত আপেক্ষিক গুরুত্বের সঙ্গে ০০৪ বিয়োগ করতে হয়। এভাবে প্রকৃত আপেক্ষিক গুরুত্ব পাওয়া যাবে।
২০। কখনও যদি ব্যাটারীকে তাড়াতাড়ি বা উচ্চ হারে চার্জ করার প্রয়োজন হয় তাহলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে ব্যাটারীতে চার্জ কি পরিমাণ আছে। দ্বিতীয়ত ব্যাটা-রীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা কিরূপ আছে অর্থাৎ প্লেট এবং সেপারেটর ভাল আছে কিনা। যদি প্লেট ও সেপারেটর ভাল না থাকে তবে উচ্চ হারে চার্জ দিলে দ্রুত এবং আরও দ্রুত প্লেট ও সেপারেটরগুলি নষ্ট হয়ে যাবে।
২১। ব্যাটারী অকেজো অবস্থায় বহুদিন রাখলে ব্যাটা-রীর প্লেটগুলি নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাটারী আস্তে আস্তে ডিসচার্জ হওয়ার দরুন প্লেটগুলিতে সালফেট জমতে থাকে। বেশীদিন থাকলে প্লেটে খুব মোটা বা পুরু সালফেট জমে। ব্যাটারী এইভাবে অকেজো অবস্থায় ফেলে রাখলে বহু টাকার মাল নষ্ট হয়ে যায়। এইরূপ ব্যাটারী পানি দ্বারা ধুয়ে পুনরায় চার্জ করলে (ইলেকট্রোলাইট দিয়ে) পুনরায় প্লেটগুলি সতেজ হয় বা কখনও হয় না। অনেক সময় দেখা যায় ব্যাটারী প্লেটে বেশী সালফেট থাকার দরুন চার্জ হতে দেরী হয়।
২২। ব্যাটা-রীর প্রতি প্লেটে সাধারণত ৫ বা ৬ অ্যাম্পেয়ার থাকে। প্লেট আকারে ছোট— বড় হলে প্রতি প্লেটে অ্যাম্পেয়ার কমবেশী হতে পারে।
২৩। পজেটিভ প্লেট দেখতে বাদামী রঙের এবং নেগেটিভ প্লেট ধূসর রঙের হয়ে থাকে।
ব্যাটারীর ধারকত্ব (Capacity)
একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাটারীর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতাকে ব্যাটারীর ধারকত্ব বলে। এটা অ্যাম্পেয়ার আওয়ার হিসাবে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাটারী এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ কত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম তা বের করা হয়। অ্যাম্পেয়ার আওয়ার (ampere hour বা A.H) ব্যাটারীর ধারকত্বের একক। যেমন, একটি ব্যাটারীতে ৬ ভোল্ট ১০০ অ্যাম্পেয়ার আওয়ার লেখা আছে। এর অর্থ হচ্ছে ঐ ব্যাটারীটি এক ঘণ্টায় ১০০ অ্যাম্পেয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। যদি ১০ অ্যাম্পেয়ার করে খরচ হয় তবে উক্ত ব্যাটারী ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।
১। ব্যাটারী চার্জ করার সময় ব্যাটারীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া :
(ক) সালফিউরিক অ্যাসিড আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
(খ) ডিস্টিল্ড ওয়াটার আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
(গ) পজেটিভ প্লেট থেকে লেড সালফেট আস্তে আস্তে কমে লেড পারঅক্সাইড হতে থাকে।
(ঘ) নেগেটিভ প্লেট হলে লেড সালফেট আস্তে আস্তে কমে লেড স্পঞ্জ হতে থাকে।
২। পূর্ণ চার্জ হওয়ার পর কি হয় :
(ক) সালফিউরিক অ্যাসিড বেড়ে এবং পানির ভাগ কমে আপেক্ষিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় (১.২৫০ থেকে ১.২৮০)।
(খ) পজেটিভ প্লেট লেড পারঅক্সাইড হয়।
(গ) নেগেটিভ প্লেট লেড স্পঞ্জ হয়।
৩। বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার সময় কি হয় :
(ক) সালফিউরিক অ্যাসিড আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
(খ) ডিস্টিল্ড ওয়াটার আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
(গ) পজেটিভ প্লেটে লেড পারঅক্সাইড কমতে থাকে এবং লেড সালফেট জমতে থাকে।
(ঘ) নেগেটিভ প্লেটে লেড স্পঞ্জ কমতে থাকে এবং লেড সালফেট বাড়তে থাকে।
৪। ডিসচার্জ হওয়ার পর কি হয় :
(ক) সালফিউরিক অ্যাসিড কমে যায় এবং পানির ভাগ বেড়ে যায় (আঃ গুঃ ১.১০ হতে ১.১২৫ হয়)।
(খ) পজেটিভ প্লেটে পারঅক্সাইড কমে বেশী লেড সালফেট জমা হয়।
(গ) নেগেটিভ প্লেটে লেড স্পঞ্জ কমে লেড সালফেট বেশী জমা হয়। এমতাবস্থায় ব্যাটারী পুনরায় চার্জ করতে হয়।
আরও দেখুনঃ
- প্রেসার ট্যাঙ্কের সাহায্যে এয়ার ব্লিডিং পদ্ধতি
- ব্রেক পদ্ধতি
- ডিফারেনসিয়াল খোলা এবং লাগানো
- প্রোপেলার শ্যাফট বা ড্রাইভ শ্যাফট
- স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশন পদ্ধতি
- মোটরগাড়ি শিল্প
2 thoughts on “স্টোরেজ ব্যাটারীর সাধারণ নিয়মাবলী”