ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী

ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী – আজকের আলোচনার বিষয়।  এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী

ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং

 

 ২.৫ চিত্রের সাহায্যে চারঘাত পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী এবং ফুয়েল পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। প্রথমে পেট্রোল ফিলটারের সাহায্যে পরিশোধিত হয়ে এ. সি. পাম্পে প্রবেশ করে। কারণ ঐ সময় এ. সি. পাম্পের ডায়াফ্রাম নীচের দিকে থাকে এবং চেক ভাল্‌ভ (১) ঐ সময় খোলা থাকে বা খুলে যায় এবং ঐ পথে পেট্রোল এ, সি, পাম্পে প্রবেশ করে।

আবার ডায়াফ্রাম যখন উপরের দিকে উঠে তখন তেলের চাপে চেক ভাল্ভ (১) বন্ধ হয়ে যায় এবং ২ নম্বর চেক ভাল্ভ খুলে যায়। ফলে তেল এ, সি পাম্প হতে ফ্লোট প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। এ.সি পাম্প ক্যামশ্যাফটের কেন্দ্রাপসারী (eccentric) দ্বারা পরিচালিত হয়।

কেন্দ্রাপসারীর উচ্চ অংশ যখন রকার আর্মকে স্পর্শ করে তখন পুল এন্ড পুশ রডের সাহায্যে ডায়াফ্রাম নীচের দিকে নেমে আসে। ফলে শোষণ (suction) হয়, অর্থাৎ তেল ট্যাঙ্ক হতে এ.সি পাম্পে আসে। আবার কেন্দ্রাপসারীর নিম্নাংশ যখন রকার আর্মকে স্পর্শ করে তখন পুল এন্ড পুশ রড এবং স্প্রিং-এর সাহায্যে ডায়াফ্রাম উপরের দিকে উঠে আসে। ফলে তেল পাম্প হয়ে কারবুরেটরের ফ্লোট প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। ফ্লোট প্রকোষ্ঠ হতে তেল মেইন জেট-এর সাহায্যে স্প্রে হয় এবং বাতাসের সঙ্গে মিশে ইনটেক ম্যানিফোল্ডের সাহায্যে ইনটেক ভাল্ভের মাধ্যমে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে।

 

সাকশন স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকের সময় ইনটেক ভাল্ভ খোলা থাকে এবং একজস্ট ভাল্ভ বন্ধ থাকে। পিস্টন নীচের দিকে নামতে থাকে, ফলে ইনটেক ভাল্ভ দ্বারা বাতাস এবং পেট্রোল মিশ্রিত হয়ে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। ইহাই সাকশন স্ট্রোক। এই স্ট্রোকে পিস্টন যখন নীচের দিকে নামে তখন সিলিন্ডারের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপে বাতাস কারবুরেটর, ইনটেক মানিফোল্ড এবং ইনটেক ভাল্ভ হয়ে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। কারবুরেটর একটি মিশ্রণ আবিষ্কার (mixing device)। এতে ইঞ্জিনের চাহিদা অনুসারে বাতাস এবং তেল মিশ্রিত হয়। ভেনচুরী কারবুরেটরের একটি অংশ। এখানে মেইন জেট অবস্থিত। ভেনচুরী থাকার জন্যই কারবুরেটরে মিশ্রণ ভাল হয়।

ভেনচুরী কারবুরেটরে স্বাভাবিক বাতাস চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়। অর্থাৎ ইহা কারবুরেটরের একটি সরু পথ বিশেষ, যেখানে বাতাসের চাপ কম কিন্তু গতিবেগ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাতাস ও তেল ভালভাবে মিশ্রিত হবার সুযোগ পায় ।

 

কম্প্রেশন স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকের সময় পিস্টন B.D.C হতে T.D.C-তে উঠতে থাকে এবং এক্সজস্ট ও ইনটেক ভাল্ভদ্বয় বন্ধ থাকে। ফলে বাতাস এবং পেট্রোল মিশ্ৰণ সঙ্কুচিত হতে থাকে। এর ফলে চাপ এবং তাপমাত্রা বাড়তে থাকে ৬৬–২১০ (P.S.I.)। একে কম্প্রেশন স্ট্রোক বলে।

কম্প্রেশন স্ট্রোকের শেষ মুহূর্তে স্পার্ক প্লাগে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ সংঘটিত হয় (১১০০০ হতে ১৮০০০ ভোল্টেজে)। ফলে চাপ বাড়ে ২০০ P.S.I. হতে ৫০০ P.S.I (পাউন্ড বর্গ ইঞ্চিতে) এবং তাপমাত্রা বাড়ে ১৫০০° ফারেনহাইট থেকে ২০০০ ফারেনহাইট।

 

পাওয়ার স্ট্রোক :

কম্প্রেশন স্ট্রোকের শেষে সিলিন্ডারের মধ্যে হাই ভোল্টেজে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ হয় ; ফলে বাতাস এবং পেট্রোল মিশ্রণ জ্বলে যায় এবং অত্যধিক চাপ এবং তাপের সৃষ্টি হয়। এই অত্যধিক চাপের ফলেই পিস্টন প্রবল বেগে নীচের দিকে নেমে আসে। পিস্টনের এই প্রবল চাপ কানেকটিং রডের সাহায্যে ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের উপর বর্তায়। ফলে উহা ঘূর্ণায়মান হয়। এই ঘূর্ণনের ফলেই গাড়ী রাস্তায় চলাচল করে। এই স্ট্রোকের সময়ও উভয় ভাল্ভ বন্ধ থাকে। ইহাই পাওয়ার স্ট্রোক।

 

একজস্ট স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকে পিস্টন B.D.C. হতে T.D.C.-এর দিকে যেতে থাকে। এ সময় একজস্ট ভালভ খোলা থাকে ; ফলে ঐ পথে পোড়া গ্যাস বের হয়ে যায়। এ সময় ইনটেক ভালভ বন্ধ থাকে। কারণ ভাল্ভ টাইমিং এভাবেই করা হয়ে থাকে। কিন্তু একজস্ট স্ট্রোকের শেষে ইনটেক ভাল্ভ আবার খুলে যায় এবং বাতাস ও পেট্রোল মিশ্রণ পুনরায় সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। এভাবেই সাইকেল একের পর এক চলতে থাকে। ইহাই চার-ঘাত পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী।

 

ফ্লোট প্রকোষ্ঠ (Float chamber) :

এটি কারবুরেটরের একটি অংশ। এই প্রকোষ্ঠে সব সময় কিছু পরিমাণ পেট্রোল জমা থাকে। এই প্রকোষ্ঠে একটি ফ্লোট থাকে। এটি তেলের উপর ভাসে। এই ফ্লোটটি একটি পিভট পিন দ্বারা নিড়ল ভাল্ভ এর সাথে সংযুক্ত থাকে।

এ সি. পাম্প হতে তেল ফ্লোট প্রকোষ্ঠে যে পথে আসে সে পথে একটি নিড্‌ল ভাল্ভ থাকে। ফ্লোটের উঠানামার উপরই নিড়ল ভাভে তেল আসার পথ বন্ধ অথবা খুলে দেওয়ার সম্পর্ক। ফ্লোট প্রকোষ্ঠে নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল থাকলে নিড্‌ল ভাল্ভ তেল আসার পথ বন্ধ রাখে আর যদি তেল কম থাকে তাহলে তেল আসার পথ খুলে দেয়। অর্থাৎ এ. সি পাম্প হতে তেল ফ্লোট প্রকোষ্ঠে আসতে দেয়। ফ্লোট সীমা হতে মেইন জেট সব সময় ৩২” উপরে থাকে। ফলে তেল সব সময় ফোঁটা ফোঁটা আকারে পড়তে পারে না।

 

এ. সি. পাম্প (Automatic control pump) :

ফ্লোট প্রকোষ্ঠে তেল পূর্ণ থাকলে এ. সি. পাম্প হতে তেল ফ্লোট প্রকোষ্ঠে আসে না। কারণ নিল ভাল্ভ তখন বন্ধ থাকে। ফলে ফ্লোট প্রকোষ্ঠ হতে এ. সি. পাম্প পর্যন্ত জ্বালানি পথে চাপের সৃষ্টি হয়, কারণ ইঞ্জিন তখন চলতে থাকে। জ্বালানি পথের এই চাপ এ. সি. পাম্প এর ডায়াফ্রামে গিয়ে পৌঁছে।

ডায়াফ্রাম তখন পুল এবং পুশ রডকে নীচের দিকে ধাক্কা দেয়। ফলে রকার আর্ম ক্যামইসেনট্রিক হতে কয়েক থাউ সরে আসে অথবা ক্যামইসেনট্রিকের ধাক্কা রকার আর্মের উপর কমে যায়। ফলে অল্প সময়ের জন্য এ. সি. পাম্পে চাপ হয় না (হলেও খুব কম)।

অতএব অল্প সময়ের জন্য তেল সরবরাহ বন্ধ থাকে। কিছু সময় পরেই যখন ফ্লোট প্রকোষ্ঠ হতে তেল কমে যায় অর্থাৎ ইঞ্জিনের চাহিদা অনুসারে সিলিন্ডারে চলে যায় তখন আবার নিড়ল ভাল্ভ খুলে যায় এবং তেল এ. সি. পাম্প হতে ফ্লোট প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। এই পদ্ধতি আপন নিয়ম অনুসারেই হতে থাকে বলে একে অটোমেটিক কন্ট্রোল পাম্প বলে। এর বিভিন্ন অংশ ও গঠন-প্রণালী (সাধারণ) ২.৫ চিত্রে দেখানো হয়েছে। এই পাম্পের চাপ সাধারণত ২ হইতে ৭-১/২ পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে হয়।

 

ফোর স্ট্রোক বা চার ঘাত ডিজেল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী :

২৬ ক, খ, গ চিত্রে ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ ও গঠন প্রণালী এবং এই ইঞ্জিনের জ্বালানি পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। চার ঘাত পেট্রোল ইঞ্জিনের ন্যায় চার ঘাত ডিজেল ইঞ্জিনে ক্ষমতা অর্জন করতে পিস্টনের চারবার উঠানামা করতে হয়। ডিজেল ইঞ্জিনে ১, ৪, ৬, ৮, ১২ সিলিণ্ডারবিশিষ্ট হয়ে থাকে। এই ইঞ্জিনের কার্যাবলীকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : (ক) সাকশন স্ট্রোক, (খ) কম্প্রেশন স্ট্রোক, (গ) পাওয়ার স্ট্রোক, (ঘ) একজস্ট স্ট্রোক।

ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং

ডিজেল ইঞ্জিনে কারবুরেটর ব্যবহার করা হয় না। কারণ ডিজেল ইঞ্জিনের সাকশন স্ট্রোকে শুধুমাত্র বাতাস সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। পেট্রোল ইঞ্জিনে মিশ্রণকে দহন করার জন্যে বৈদ্যুতিক স্পার্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডিজেল ইঞ্জিনে দহনকার্য সম্পাদনের জন্য হাইপ্রেসার পাম্প এবং ইনজেকটর ব্যবহৃত হয়। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে কার্যাবলী আলোচনা করা হলো।

 

ক. সাকশন স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকের সময় পিস্টন টি.ডি. সি. হতে বি.ডি.সি-এর দিকে নামতে থাকে। ইনটেক ভালভ খোলা থাকে এবং একজস্ট ভালভ বন্ধ থাকে। এই স্ট্রোকে শুধুমাত্র বাতাস ইনটেক ভাল্ড-এর সাহায্যে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে।

ফোর-স্ট্রোক পেট্রোল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং

খ. কম্প্রেশন স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকে উভয় ভাল্ভ বন্ধ থাকে। পিস্টন বি.ডি.সি. হতে টি.ডি.সি-এর দিকে যেতে থাকে। ফলে সাকশন স্ট্রোকে নেওয়া বাতাস সঙ্কুচিত হতে থাকে। এর ফলে চাপ এবং তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। চাপ ৪৫০ হতে ৫৫০ পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে এবং তাপমাত্রা ৯০০° ফাঃ হতে ১১০০° ফাঃ। ইহাই কম্প্রেশন স্ট্রোক।

 

গ. পাওয়ার স্ট্রোক :

এই সময় উভয় ভাল্ভ বন্ধ থাকে। পিস্টন টি.ডি.সি হতে বি.ডি.সি-এর দিকে নামতে থাকে। কম্প্রেশন স্ট্রোকের শেষেই পাওয়ার স্ট্রোক শুরু হয়, অর্থাৎ কম্প্রেশন স্ট্রোকের শেষে হাইপ্রেসার পাম্প ইনজেকটরের সাহায্যে উচ্চচাপে ডিজেল স্প্রে করে (১৫০০ হতে ৩৫০০ পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে)।

ফলে সিলিন্ডারের মধ্যে ফায়ারিং হয় (firing) এবং চাপে বেড়ে যায় ৫০০ হতে ৭৫০ পি.এস.আই (P.S.I) পর্যন্ত এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ২০০০° ফাঃ হতে ২৫০০০° পর্যন্ত। পাওয়ার স্ট্রোকের এই অত্যধিক চাপে পিস্টন প্রবল বেগে টি.ডি.সি. হতে বি.ডি.সি এর দিকে নেমে আসে। ফলে ফ্র্যাঙ্কশ্যাফট ঘূর্ণায়মান হয়। এই শক্তিই বিভিন্ন ইউনিটের মাধ্যমে চাকায় যায়। ইহাই পাওয়ার স্ট্রোক।

 

ঘ. একজস্ট স্ট্রোক :

এই স্ট্রোকের সময় পিস্টন বি.ডি.সি. হতে টি.ডি.সিতে যেতে থাকে। ইনটেক ভাল্ভ বন্ধ থাকে। কিন্তু একজস্ট ভাল্ভ খুলে যায়। ফলে এই পথে পোড়া গ্যাস একজস্ট মেনিফোল্ড এর মাধ্যমে বের হয়ে যায়। এর পরপরই ইনটেক ভাল্ভ পুনরায় খুলে যায় এবং বাতাস সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়া পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। ফলে একটি গাড়ী গতিশীল থাকে। ইহাই চারঘাত ডিজেল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী।

 

আর দেখুনঃ