জেনারেটরে যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়া ও পরীক্ষাকরণ – এই পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের “চার্জিং ও স্টার্টিং পদ্ধতি” অধ্যায়ের একটি পাঠ।
জেনারেটরে যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়া ও পরীক্ষাকরণ
জেনারেটরের ব্রাশসমূহ নষ্ট হতে পারে বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। অনেক সময় ব্রাশ সংযোগ কম হলে (কমুটেটরের সঙ্গে) বিদ্যুৎ কম অথবা মোটেই সরবরাহ হতে পারে না। আবার ব্রাশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কমুটেটরের উপরিভাগ ময়লায় আবৃত হলে জেনারেটর কম অথবা .মোটেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না। এমতাবস্থায় জেনারেটর গাড়ী থেকে খুলে আনতে হয় এবং ব্রাশ সংযোগ করতে হয়। অতঃপর ব্রাশ ঘর্ষণ করে সমান করে দিতে হয় অথবা ‘ ব্রাশ বদলী করতে হয়। কমুটেটর ভাল স্যান্ড-পেপার দ্বারা খুব সতর্কতার সঙ্গে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
চলন্ত অবস্থায় যদি জেনারেটরে কিচকিচ শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে জেনারেটরের বিয়ারিং অথবা বুশ নষ্ট হয়েছে।
চিত্র ৮.৪ : (ক, খ, গ,ঘ) গ্যারোলার দ্বারা ডায়নামোর বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করার পদ্ধতি।
জেনারেটর হতে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য এটি গাড়ী হতে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন হয় না। জেনারেটরের আউটপুট টার্মিনাল হতে কাট আউটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এমতাবস্থায় একটি সিরিজ বাতির একপ্রান্ত জেনারেটরের আউটপুট টার্মিনালে এবং অন্যপ্রান্ত বডিতে ধরে রাখা অবস্থায় ইঞ্জিন চালালে যদি বাতি জ্বলে উঠে তাহলে মনে করতে হবে জেনারেটর ভাল আছে।
অ্যাম্পেয়ার মিটার এবং ভোল্টমিটার দ্বারা এর আম্পেয়ার এবং ভোল্ট নির্ণয় করা যায়। অ্যাম্পেয়ার মিটার জেনারেটরের আউটপুট টার্মিনালের সঙ্গে সিরিজে সংযোগ দিতে হবে এবং ভোল্টমিটার সমান্তরাল সংযোগ দিয়ে ইঞ্জিন চালালে এবং গতিবেগ ৫০০/৭০০ আর. পি. এম. এ রাখলে মিটার দুটির অ্যাম্পেয়ার এবং ভোল্ট জানা যাবে।
কোনো কিছু না থাকলেও জেনারেটরের আউটপুট পরীক্ষা করা যায়। ইঞ্জিন চালু রেখে গতিবেগ ৪০০/৫০০ আর.পি.এম-এ রেখে আউটপুট টার্মিনাল হতে এক টুকরা তারের সাহায্যে বডিতে স্পর্শ করলে যদি স্পার্ক হয় তবে বুঝতে হবে জেনারেটর ভাল আছে।
উপর্যুক্ত প্রক্রিয়া চালানোর পরও যদি দেখা যায় জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না তাহলে তা সম্পূর্ণ খুলে ফেলতে হবে এবং সিরিজ বাতি দ্বারা অথবা সমান্তরাল দ্বারা ফিল্ড কয়েল, আর্মেচার, ব্রাশ পরীক্ষা করতে হবে। আর্মেচার কোন শ্যাফট বা বড়ির সঙ্গে শর্ট বা গ্রাউন্ড হওয়া উচিত নয়। যদি হয় তবে তা খারাপ হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
ফিল্ড কয়েলের কোনো স্থান শ্যাফটের সঙ্গে শর্ট বা গ্রাউন্ড অথবা কয়েলের কোনো অংশ কাটা বা ছেঁড়া থাকা উচিত নয়। যদি থাকে তা হলে কার্যোপযোগী নয় বলে বিবেচিত হবে। গ্যারোলার দ্বারা শর্ট, গ্রাউন্ড অথবা সংযোগ পরীক্ষা করা যায়। এইজন্য দুইটি টেস্ট প্রড, V–ব্লক আকারে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র, একটি পাতলা ছুরি, একটি আলো এবং একটি অ্যাম্পেয়ার মিটারও থাকে। আর্মেচার পরীক্ষা করার জন্য গ্যারোলারের V-ব্লকের উপর স্থাপন করতে হবে। এমতাবস্থায় সুইচ চালু করতে হবে এবং V-ব্লকের উপর রাখা অবস্থায় আর্মেচারটি হাত দ্বারা ঘুরাতে হবে এবং পাতলা ছুরিটি
১ইঞ্চি / ৪ বা ১ ইঞ্চি / ৮ ব্যবধান রেখে আর্মেচারের উপরে স্পর্শ করাতে হবে। আর্মেচারের কোনো পরিবাহক বা তার যদি শর্ট থাকে তাহলে সেই তারের নিকট আসা মাত্রই পাতলা ছুরিটিকে আর্মেচার কোরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে অর্থাৎ বুঝা যাবে যে আর্মেচার শর্ট হয়েছে।
টেস্ট প্রড দ্বারা কমুটেটর আর্মেচার শ্যাফটের সাথে গ্রাউন্ড হয়েছে কিনা তাও নির্ণয় করা যায়। টেস্ট প্রডের একটি লিড আর্মেচার পরিবাহকের সঙ্গে অপর প্রড শ্যাফটে ধরলে যদি আলো জ্বলে ওঠে তাহলে আর্মেচার শ্যাফটের সাথে গ্রাউন্ড হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আর্মেচার থেকে বিদ্যুৎ দিবে না। ভাল ইনসুলেশন দ্বারা গ্রাউন্ড হওয়া রোধ করতে হবে। অনুরূপভাবে ফিল্ড কয়েল এবং ব্যাসসমূহ পরীক্ষা ও নির্ণয় করা যায়। সিরিজ ল্যাম্প দ্বারা উপরোক্ত পরীক্ষাসমূহ করা যায় (৮.৫ চিত্র দ্রষ্টব্য)।
জেনারেটর কর্তৃক ব্যাটারী চার্জকরণ এবং ভোল্ট ও বিদ্যুৎ রেগুলেটরের কাজ মোটর গাড়ীতে যদিও ১২ ভোল্টের ব্যাটারী ব্যবহার করা হয় কিন্তু জেনারেটর ব্যবহার করা হয় ১৪ বা ১৫ ভোল্টের। জেনারেটর যাতে ব্যাটারীকে ওভার চার্জ না দিতে পারে তার জন্য চার্জিং বর্তনীতে বিদ্যুৎ ও ভোল্টেজ রেগুলেটর ব্যবহার করা হয়। চার্জিং বর্তনীতে আরও একটি ইউনিট ব্যবহার করা হয়, তা হচ্ছে কাট আউট রিলে (৮.৬ ক চিত্র দ্রষ্টব্য)।
ভোল্টেজ ও বিদ্যুৎ রেগুলেটর : এর গঠন, অবস্থান ও সংযোগ চিত্রের সাহায্যে দেখানো হয়েছে। বিদ্যুৎ সাধারণভাবে বেশী রোধবিশিষ্ট তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে চায় না (যদি সেখানে কম রোধের তার থাকে)। বিদ্যুৎ এবং ভোল্টেজ রেগুলেটরদ্বয় নির্দিষ্ট (১০-১২) ভোল্টেজের মধ্যে এবং (২০ হতে ৩০ অ্যাম্পেয়ারের) নির্দিষ্ট অ্যাম্পেয়ারের মধ্যে সেট করা থাকে।
নির্দিষ্ট ভোল্টেজ পর্যন্ত ভোল্টেজ রেগুলেটর কোন বাঁধার সৃষ্টি করে না। কিন্তু জেনারেটর যখন নির্দিষ্ট ভোল্টেজের বেশী ভোল্টেজ সরবরাহ করে তখন ভোল্টেজ রেগুলেটর কোরটি শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয় এবং আর্মেচার বা কন্ট্রাক্ট বিন্দু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ এটি কোরের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং বেশী রোধের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় বিধায় ভোল্টেজ কমে যায়। এভাবে ভোল্টেজ রেগুলেটর বেশী ভোল্টেজ সরবরাহ করার হাত থেকে বৈদ্যুতিক বর্তনীগুলিকে রক্ষা করে থাকে।
ভোল্টেজ রেগুলেটরের ফাঁক সাধারণত .০৫০” হতে ০৭৫” হয়ে থাকে। ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণের জন্য ফাঁকটি সাধারণত প্রতি সেকেন্ডে ৬০ থেকে ২৪০ বার খুলে এবং বন্ধ হয়। এই ফাঁক সমন্বয় করে ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বিদ্যুৎ রেগুলেটরের ফাঁক .০৫০” হতে ০৭৫” নির্ধারণ করা থাকে। ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে বিদ্যুৎ এবং ভোল্টেজ রেগুলেটরদ্বয়ের সি. বি. বিন্দু বন্ধ থাকে কিন্তু কাটআউট খোলা থাকে। যদি কাটআউটের সি. বি. বিন্দু বন্ধ থাকে (ইঞ্জিন বন্ধ থাকা অবস্থায়) তাহলে ব্যাটারী ডিসচার্জ হয়ে যাবে।
জেনারেটর যখন বেশী বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তখন বিদ্যুৎ রেগুলেটর কোরটি শক্তিশালীচুম্বকে পরিণত হয় এবং বিদ্যুৎ রেগুলেটরের আর্মেচারটিকে স্প্রিং টেনশনের বিপক্ষে কোর-এর দিকে টেনে নেয়। ফলে বিদ্যুৎ তখন সরল পথে না যেয়ে বেশী রোধের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গ্রাউড হয়। ফলে বিদ্যুৎ কমে যায়, অর্থাৎ জেনারেটরের আউটপুট কমে যায়। এইভাবে বিদ্যুৎ রেগুলেটর বেশী বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রিত করে সব বর্তনী এবং ব্যাটারী রক্ষা করে। বিদ্যুৎ রেগুলেটরের সি. বি. বিন্দু প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ হতে ২৫০ বার খুলে এবং বন্ধ হয় ।
কাটআউট রিলের কাজ :
কাটআউট রিলে তিন ভাবে কাজ করে। যেমন, ব্যাটারীতে কম ভোল্টেজ থাকলে ব্যাটারীকে চার্জ করতে সহায়তা করে। ব্যাটারী পূর্ণ চার্জ থাকলে ব্যাটারীকে চার্জ করতে দেয় না। ব্যাটারীতে বেশী ভোল্ট থাকলে কিন্তু জেনারেটরে কম ভোল্ট থাকলে (ইঞ্জিনের কম গতিতে) অথবা ইঞ্জিন বন্ধ থাকাকালীন ব্যাটারী হতে বিদ্যুৎ খরচ হতে দেয় না।
কাটআউট রিলের বায়ুশূন্যতা থাকে সাধারণত ০.১৮” হতে ০.২০”। সাধারণ অবস্থায় এবং ইঞ্জিনের কম গতিতে কাটআউটের সি. বি. বিন্দু খোলা থাকে। কিন্তু ইঞ্জিনের গতি যখন বাড়ে (৪০০-৫০০ আর. পি. এম) তখন বিদ্যুৎ এবং ভোল্টেজ উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। ফলে লৌহ কোরটি শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয় এবং আর্মেচারটিকে টেনে নেয়। সি. বি. বিন্দু দুইটি তখন একত্র হয়। এর ফলে বিদ্যুৎ জেনারেটর হতে অ্যাম্পেয়ার মিটার হয়ে ব্যাটারীকে চার্জ করে সিরিজ কয়েলের (উইন্ডিং) মাধ্যমে। শান্ট বা সমান্তরাল (parallel) উইন্ডিং দিয়ে বিদ্যুৎ তখন একই দিকে সরবরাহ হয় অর্থাৎ ব্যাটারীকে চার্জ করে।
যখন জেনারেটরের বেগ কমে যায় অথবা ব্যাটারীর ভোল্টেজ জেনারেটরের ভোল্টেজ অপেক্ষা বেশী হয় অথবা সমান হয় তখন বিদ্যুৎ বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়, অর্থাৎ ব্যাটারী থেকে জেনারেটরের দিকে সিরিজ উইন্ডিং-এর মাধমে যেতে থাকে। কিন্তু শান্ট বা সমান্তরাল উইন্ডিং-এর সাহায্যে বিদ্যুৎ তখন পূর্বের দিকেই প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে উভয় উইন্ডিং-এর মধ্যে পরস্পর বিপরীতমুখী আকর্ষণের সৃষ্টি হয় বলে লৌহ কোরটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এর ফলে লৌহ কোরটি আর্মেচারকে ধরে রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর্মেচারটি দূরে সরে যায় এবং দুটি সংযোগের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় বলে বিদ্যুৎ আর কোনোদিকেই প্রবাহিত হতে পারে না। এভাবে কাটআউট রিলে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২৫০ বার খুলে ও বন্ধ হয় ।
মেরু নির্ণয় : জেনারেটরে যেসব ফিল্ড কয়েল ব্যবহার করা হয় তা কখনও কখনও মেরামত বা পরিবর্তন করতে হয়। মেরামত বা পরিবর্তন করার পর পুনরায় জেনারেটর হাউজিং-এর মধ্যে সংযুক্ত করা হয়। সংযোগ যদি ভুল হয় তবে ফিল্ড কয়েলের মেরু পরিবর্তন হয়ে যায়।
ফিল্ড কয়েলে সবসময় বিপরীতমুখী পোলপিস থাকে। ফিল্ড কয়েলের একটিতে উত্তর মেরু অপরটিতে দক্ষিণ মেরু সৃষ্টি হয় বিধায় বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। মেরু পরিবর্তন হলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে না। চিত্র ৮.৬ (ঘ) দ্বারা মেরু পরীক্ষা করার পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। ব্যাটারীর সাথে এবং ফিল্ড কয়েলের সাথে কিভাবে সংযোগ হবে তাও দেখানো হয়েছে। উক্ত সংযোগ দেওয়ার পর বিদ্যুৎ ফিল্ড কয়েলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং পোলপিস চুম্বক হবে। এমতাবস্থায় চৌম্বক-কম্পাস দ্বারা উভয় কয়েলের মেরু পরীক্ষা করতে হবে।
মেরু পরিবর্তন বা উল্টা হলে ফিল্ড কয়েল খুলে বদলী করে পুনরায় লাগিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
আরও দেখুনঃ
- ফাইলিং করার জন্য ভাইস এর ব্যবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- যন্ত্রাংশে রূপ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত ফাইল | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ট্র্যামেল এর ব্যাবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- শিক্ষানবিস যন্ত্রবাক্সে যা যা যন্ত্রাদি থাকা বাঞ্ছনীয় | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- ছোট বড় গোলাকার ছিদ্রের জন্য ড্রিলের ব্যবহার | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- মোটরগাড়ি শিল্প
3 thoughts on “জেনারেটরে যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়া ও পরীক্ষাকরণ”