একাধিক খণ্ডকে একত্র করতে ওয়েল্ডিং এর ব্যাবহার – পাঠটি “অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং” বিষয়ের “শীট মেটাল ফিটিং, ওয়েল্ডিং-ডেনটিং ও পেইন্টিং” পাঠের অংশ। একই জাতীয় একাধিক খণ্ডকে একত্র করতে অথবা একই বস্তুর দুই অংশকে উত্তাপের সাহায্যে অর্ধ অথবা প্রায় পূর্ণ গলিত অবস্থায় স্থায়ীভাবে যুক্ত করার পদ্ধতিকে ওয়েল্ডিং বলে। স্টীলবডি বাস, ট্রাক, ট্যাঙ্ক, গাড়ীর বডি, ফ্রেম, বনেট, বাম্পার, পাইপ লাইন, সাইলেন্সার বক্স, রড, স্টীলের প্লাটফরম, লঞ্চ স্টীমার, ফেরি, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ভগ্ন বা ফাটল ঢালাই বস্তু মেরামতের জন্য ওয়েল্ডিং অত্যন্ত উপযোগী মাধ্যম ।
একাধিক খণ্ডকে একত্র করতে ওয়েল্ডিং এর ব্যাবহার
ওয়েল্ডিং–এর প্রকারভেদ :
ওয়েল্ডিং প্রধানত দুই প্রকার : (ক) প্রেশার ওয়েল্ডিং এবং (খ) ফিউশন ওয়েল্ডিং। প্রেশার ওয়ে-ল্ডিং আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়— (১) ফোর্স ওয়েল্ডিং, (২) ইলেকট্রিক রেজিস্ট্যান্স ওয়েল্ডিং। ইলেকট্রিক রেজিস্ট্যান্স আবার তিন প্রকার : (১)স্পটওয়েলডিং, (২)সীম ওয়েল্ডিং (seam welding), (৩) বাট ওয়েল্ডিং (butt welding)। ফিউশন ওয়েল্ডিং (Fusion welding) আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : (১) গ্যাস ওয়েল্ডিং, (gas welding), (২) ইলেকট্রিক আর্ক ওয়েল্ডিং (Electric arc welding)।
প্রেশার ওয়েল্ডিং (Pressure welding) :
এই পদ্ধতিতে ধাতুখণ্ডদ্বয়ের জোড়া দেওয়ার স্থান অর্ধ–গলিত অবস্থায় আনয়নের পরে চাপের সাহায্যে ধাতুখণ্ডদ্বয় সংযুক্ত করা হয় !
ফিউশন ওয়েল্ডিং (Fuşion welding) :
এই পদ্ধতিতে ধাতুখণ্ডদ্বয়ের জোড়া দেওয়ার স্থান প্রায় গলিত অবস্থায় আনয়নের পর কোন প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই ধাতুদ্বয় জোড়া লাগানো হয়। প্রয়োজনবোধে অতিরিক্ত কিছু ধাতু জোড়ার স্থানে সংযুক্ত করে জোড়া দেওয়া হয় ।
ফোর্স ওয়েল্ডিং (Forge welding) :
কামারশালায় চুল্লীর মধ্যে দুটি ধাতুখণ্ড উত্তপ্ত করে হাতুড়ির আঘাতের সাহায্যে দুটি খণ্ড একত্র ঝোড়া লাগানোকেই ফোর্স ওয়ল্ডিং বলে।
ইলেকট্রিক রেজিস্ট্যান্স ওয়েল্ডিং :
এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুটি ধাতুখণ্ড অর্ধ–গলিত অবস্থায় আনয়নের পর চাপের সাহায্যে সংযুক্ত করা হয়। সীম ওয়ল্ডিং, বাট ও-য়েল্ডিং এবং স্পষ্ট ও-য়েল্ডিং এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।
আর্ক ওয়েল্ডিং এর যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি:
(ক) ওয়ে-ল্ডিং মেশিন, (খ) ইলেট্রিক টেস্টার বা নিয়ন টেস্টার, (গ) গগলস (goggles), হেলমেট (Helmet) বা রঙিন কাচযুক্ত মুখাবরণ (welding shield), )(ঘ) চিপিং হ্যামার (chipping hammer), (ঙ) টং (Tong), (চ)ইনস্যুটেড প্লায়ার্স (Insulated plaires), (ছ) ছেনী (chisel), (জ) ধাতুনির্মিত ওয়েল্ডিং টেবিল,
(ঝ) ইলেকলেট্রাড হোল্ডার (Electrode holder), (ঞ) ইলেকট্রিক ক্যাবল বা ওয়েল্ডিং ক্যাবল, (ট) ইলেকট্রোড (Electrode), (ঠ) চামড়ার তৈরী দস্তানা (Leather gloves), (ড) চামড়ার তৈরী দেহাবরণ (Leather apron ), (ঢ) তারের ব্রাশ (wire brush), (ণ) গ্রাইন্ডিং মেশিন, (ত) ক্ল্যান্স, (থ) ফাইল, (দ) পানির বালতি, (ধ) বালির বালতি, (ন) অগ্নি–নির্বাপক যন্ত্র ।
আর্ক ওয়েল্ডিং এ সাবধানতা :
আর্ক ওয়েল্ডিং করার সময় নিম্নলিখিত নিয়মাবলী মেনে চলা দরকার। (ক) আর্ক ওয়েল্ডিং-এর সময় পেট্রোল, কেরোসিন, ওয়েস্ট কটন, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি কাছাকাছি স্থানে রাখা অনুচিত।
- (খ) বৈদ্যুতিক যোগাযোগ যথাযথভাবে দিতে হবে।
- (গ) চোখে গগলস বা রঙিন চশমা ছাড়া ওয়েল্ডিং করা অনুচিত।
- (ঘ) দস্তানা ও দেহাবরণ ছাড়া ওয়েল্ডিং করা উচিত নয় ।
- (ঙ)আবদ্ধ ঘরে ওয়েল্ডিং করা একেবারেই উচিত নয় ৷
- (চ) সহজদাহ্য বস্তুর উপর ওয়ে-ল্ডিং করা অনুচিত।
- (ছ) ইলেকট্রোড হোল্ডার ধাতুখণ্ডের উপর রাখা উচিত নয় ৷
- (জ) ওয়েল্ডিং মেশিন উত্তমরূপে আর্থ (earth) না করে ওয়েল্ডিং করা উচিত নয় । 42 (ঝ) ওয়েল্ডিং শেষ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ সুইচের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয় ।
- (ঞ) ইলেকট্রোডের শেষাংশ নির্দিষ্ট ও নিরাপদ স্থানে রাখা দরকার
- (ট) ইলেকট্রোড হোল্ডারের সাহায্যে ইলেকট্রোড ভালভাবে ধারণ না করে ওয়েল্ডিং করা উচিত নয় ৷
গ্যাস ওয়েল্ডিং–এর যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি:
(ক) অক্সিজেন সিলিণ্ডার (Oxygen cylinder), (খ) এসিটিলিন সিলিণ্ডার (Acetylene cylinder), (গ) সিলিণ্ডার প্রেশার গেজ (Cylinder pressure gauge), (ঘ) আউটলেট প্রেশার গেজ (outlet pressure gauge), (ঙ) সেফটি ভাল্ভ (Safety valve), (চ) চাপনিয়ন্ত্রণকারী উইং নাট (pressure adjusting wing nut),
(ছ) বিশেষ ধরনের রবারের হোস পাইপ, (জ) ব্লো–পাইপ, (ঝ) নজল (পরিবর্তনীয়), (ঞ) গগলস, (ট) চিপিং হ্যামার (Chipping hammer), (ঠ) ধাতুনির্মিত ওয়েল্ডিং টেবিল, (ড) ধাতু অনুসারে ওয়েল্ডিং রড এবং ফ্যাক্স, (ঢ) প্লায়ার্স (ণ) ফাইল, (৩) সি–ক্লাম্প (C-clamp), (থ) সিলিণ্ডার টুলি, (দ) অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, (ধ) একটি দিয়াশলাই বা লাইটার।
গ্যাস ওয়েল্ডিং–এর সাবধানতা:
(ক) গ্যাস সিলিন্ডারের ভাল্ভ, রেগুলেটর, প্রেশার গেজ, ব্লো–পাইপ ইত্যাদির সাথে তেল, গ্রীজ, পেট্রোল, কেরোসিন ইত্যাদির সংযোগ ঘটানো অনুচিত। এতে সমূহ বিপদের ও বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে। 21
(খ). গ্যাস সিলিণ্ডারদ্বয়কে কখনও উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানে নিক্ষেপ করা অনুচিত এবং রোলারের ন্যায় গড়িয়ে একস্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া উচিত নয় ।
(গ) গ্যাস ওয়েল্ডিং-এর সময় গগলস/চশমা ব্যবহার করা একান্ত দরকার। নাকে ও মুখে ” রুমাল ব্যবহার করা ভাল।
(ঘ) অগ্নিশিখা থেকে সবসময় গ্যাস সিলিণ্ডার দূরে রাখতে হবে।
(ঙ) ওয়েল্ডিং করার স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত।
চ) গ্যাস ওয়েল্ডিং-এর সময় কাছাকাছি স্থানে যাতে কোন দাহ্য পদার্থ না থাকে (যেমন- পেট্রোল কেরোসিন, তন্তুজাতীয় পদার্থ) সে দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
(ছ) কোন পাত্রে পেট্রোল, কেরোসিন, রং, স্পিরিট ইত্যাদি থাকলে কোন অবস্থাতেই তা ওয়েল্ডিং করা উচিত নয়।
(জ) কাঠ, বাশ, তক্তা ইত্যাদির উপর গ্যাস ওয়েল্ডিং করা অনুচিত।
(ঝ). আবদ্ধ ঘরে ওয়েল্ডিং করা উচিত নয়।
(ঞ) নজল এবং ব্লো-পাইপ ইত্যাদির উপর যাতে কোন আঘাত না লাগে তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।
(ট) গ্যাস সেটের ব্লো-পাইপ কাজের সময় কোথাও রাখতে হলে এর অগ্নিশিখা নিভিয়ে রাখতে হয়।
(ঠ) সিলিণ্ডারের অক্সিজেন গ্যাস শ্বাস-প্রক্রিয়ার জন্য সরাসরি টেনে নেওয়া অনুচিত। এতে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
গ্যাস ওয়েল্ডিং-এ ব্যবহৃত গ্যাস (Gas used in gas welding) :
গ্যাস ওয়েল্ডিং- এর মূল উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন গ্যাস এবং অ্যাসিটিলিন গ্যাস। অক্সিজেন ছাড়া কোন প্রাণী বাঁচে না। এটি স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণহীন গ্যাস। এটি একটি মৌলিক পদার্থ এবং বাতাস থেকে সামান্য ভারী। অক্সিজেন নিজে জ্বলে না কিন্তু অপরকে জ্বলতে সাহায্য করে। কম্প্রেসরস- এর সাহায্যে বায়ুমণ্ডল থেকে বায়ু আহরণ করে সিলিণ্ডারে জমা করা হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা শীতল করা হয় এবং পরে উচ্চচাপের সাহায্যে সঙ্কুচিত করে তরল করা হয়। এই তরল বায়ুকে ৩২০০° থেকে ৩৩০০° ফারেনহাইটে তাপ দিলে নাইট্রোজেন মুক্ত হয়ে যায়। এমতাবস্থায় এই বাতাসের তাপমাত্রা যখন (২০০ – ৩২৫° ফঃ) নেমে আসে তখন কেবল অক্সিজেন গ্যাস-এর আকার ধারণ করে।
এই অক্সিজেনকে আরও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিশোধিত করা হয় এবং উচ্চচাপে বিশেষভাবে নির্মিত পরীক্ষিত সিলিণ্ডারে প্রবেশ করানো হয়। অক্সিজেন সিলিণ্ডারগুলি অ্যাসিটিলিন সিলিণ্ডারের তুলনায় একটু লম্বা এবং সরু। কিন্তু অ্যাসিটিলিনের সিলিণ্ডারের রং ঈষৎ লালচে, একটু বেঁটে ও মোটা আকৃতির। অক্সিজেন সিলিণ্ডারের রং কাল এং তলদেশ গোলাকৃতির। কিন্তু অ্যাসিটিলিন সিলিণ্ডারের তলদেশ চেপ্টা ও অবতলাকৃতিবিশিষ্ট। অক্সিজেন সিলিণ্ডারের আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এর স্ক্রু–থ্রেডগুলি ডান—রোক–এর প্যাচ (Right hand threads) বা থ্রেডবিশিষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু অ্যাসিটিলন সিলিণ্ডারের বেলায় প্যাচগুলি বাম রোক–এর হয়ে থাকে (Left hand threads)।
অ্যাসিটিলিন গ্যাস (C2H2) :
ক্যালসিয়াম কারবাইড (Calcium carbide) এবং পানি একত্রে মিশ্রিত করলে এই গ্যাসের সৃষ্টি হয়। ক্যালসিয়াম কারবাইডকে সংক্ষেপে কারবাইড বলা হয়। ক্যালসিয়াম কারবাইড দেখতে কালো পাথরের ন্যায়। এটি বিস্ফোরক দ্রব্য নয়। কারবাইড হতে অ্যাসিটিলিন গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পর যা কাদার মতো থাকে তা চুনার অংশবিশেষ। এই গ্যাস বর্ণহীন কিন্তু অত্যন্ত বিষাক্ত এবং অত্যন্ত প্রজ্বলনীয়। এই গ্যাস অক্সিজেনের সাথে মিশে অক্সি–অ্যাসিটিলিন শিখার সৃষ্টি করে। ‘অক্সি–অ্যাসিটিলিন শিখার তাপমাত্রা ২৫০০° ফাঃ হতে ৬৫০০° ফাঃ পর্যন্ত হতে পারে।
ব্লোলা–পাইপ (Blow-pipe) :
অ্যাসিটিলিন গ্যাস জ্বালানোর পূর্বে যে নলটির মধ্যে অ্যাসিটিলিন এবং অক্সিজেন গ্যাস প্রয়োজনমত চাপে মিশানো হয় তাকে ব্লো–পাইপ বলে। এর অপর নাম ওয়েল্ডিং টর্চ (welding torch)।
গ্যাসপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্লো-পাইপে দুটি নিয়ন্ত্রণ-ভাল্ভ থাকে। একটির সাহায্যে অক্সিজেন এবং অপরটি সাহায্যে অ্যাসিটিলিন গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
রেগুলেটর (Regula3tor) :
প্রতি বর্গ ইঞ্চি গ্যাস সিলিন্ডারে সাধারণত ২০০ হতে ৩০০ পাউণ্ড চাপ থাকে। এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ব্লো-পাইপ। কার্যোপযোগী চাপ পাওয়ার জন্য সিলিণ্ডারের মুখে রেগুলেটর ব্যবহার করা হয়। দুটি সিলিণ্ডারে দুটি রেগুলেটর ব্যবহার করা হয়। এই রেগুলেটরগুলি সাধারণত একস্তর বিশিষ্ট (single stage) হয়ে থাকে। রেগুলেটরে চাপ নিয়ামক উইং নাট ঘুরিয়ে ব্লো-পাইপে আসা গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নাটের উপরস্থিত চিহ্ন দেখে চাপের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।
ফ্লাক্স (Flux) :
বেশীরভাগ ধাতুর উপরিভাগ বাতাসে অক্সিজেনের সাথে মিলিত হয়ে অক্সিডাইজড হয়ে যায়। তাপমাত্রা যত বেশী হয় অক্সিডেশনের ক্রিয়াও তত দ্রুত হয়। অক্সিডাইজড অবস্থায় ওয়েল্ডিং করলে সংযোগ ভাল না হয়ে বরং দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ রয়ে যায়। ওয়েল্ডিং ত্রুটিমুক্ত করার জন্য ধাতুর উপরিভাগে বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তু ব্যবহার করা হয়।
একেই ফ্লাক্স (Flux) বলে। ওয়েল্ডিং-এর সময় অক্সিডেশনের যে আবরণ পড়ে ফ্লাক্স তা অপসারিত করে জোড়া মজবুত করতে সহায়তা করে থাকে। ফ্ল্যাক্স পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ হওয়া দরকার। ওয়েল্ডিং-এর সময় প্রয়োজনের বেশী ফ্লাক্স ব্যবহার করা উচিত নয়। ওয়েল্ডিং-এর পরে যাতে কোন প্রকার ফ্লাক্সের কণা ওয়েল্ডিংকৃত স্থানে না থাকে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার। কারণ ফ্লাক্স ক্ষয়কারক পদার্থ।
ওয়েল্ডিং রড (welding Rod) :
এটি ঝালাই তার নামেও পরিচিত। যে ধাতুর উপর ওয়েল্ডিং করা হয় ঝালাই রডও সেই ধাতুরই হওয়া আবশ্যক। এর অপর নাম ফিলিং রড (Filling Rod)। ওয়েল্ডিং করার স্থান মজবুত করার জন্য এই রড ব্যবহার করা হয়।
গ্যাস ওয়েল্ডিং শিখা (Gas Welding Flame) :
ব্লো-পাইপের মুখ দিয়ে যখন অ্যাসিটিলিন এবং অক্সিজেন গ্যাস একসাথে বের হয় তখন ঐ গ্যাস অগ্নি স্পর্শ করা মাত্রই শিখার সৃষ্টি হয়। ব্লো-পাইপ দিয়ে অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাস যে অনুপাতে বের হয় সে অনুযায়ী শিখা বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। অবশ্য বিভিন্ন প্রকার কাজের জন্য বিভিন্ন প্রকার শিখার দরকার হয়। শিখা ভাল না হলে ওয়েল্ডিং ভাল হয় না। তাই কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের শিখা সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান থাকা দরকার। রোল-পাইপের অ্যাসিটিলিন নিয়ন্ত্রণ ভাল্ভটি পূর্ণ মাত্রায় খুলে দিয়ে ব্লো-পাইপের মুখে অগ্নিস্পর্শ করলেই যে অগ্নিশিখার উদ্ভব হয় তাকে অ্যাসিটিলিন শিখা বলে। এই শিখা
বিস্তৃত, দীর্ঘ এবং হরিদ্রাবর্ণের হয়। এই শিখা বেশী তাপ উৎপন্ন করে না বলে ওয়েল্ডিং কাজের জন্য এটি উপযোগী নয়। অ্যাসিটিলিন শিখা ব্লো-পাইপের নজল হতে দূরে উদ্ভব হলে বুঝতে হবে অ্যাসটিলিন গ্যাস বেশী বের হচ্ছে। এমতাবস্থায় অ্যাসিটিলিন নিয়ন্ত্রণ ভাল্ভটি প্রয়োজন মত নিয়ন্ত্রণ করলেই শিখা নজলের মুখে চলে আসে।
অ্যাসিটিলন শিখা নজলের মুখে যথাযথভাবে উৎপন্ন হওয়ার পর অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ ভালভটি খুললে ‘কোন’ (Cone) বা শঙ্কুর ন্যায় শ্বেতবর্ণের উজ্জ্বলক শিখার উদ্ভব হয়। এমতাবস্থায় অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ ভাল্ভটি আস্তে আস্তে খুললে যে তিনটি শিখার সৃষ্টি হয় তা হচ্ছে : ক)কারবুরাইজিং শিখা (খ) নিউট্রাল শিখা এবং (গ) অক্সিডইজিং শিখা ৷
(ক) কারবুরাইজিং শিখা (Carburising Flame) :
এই শিখার অপর নাম কারবোনাইজিং শিখা (Carbonising Flame)। চিত্রের উপরের শিখাটি হচ্ছে এই জাতীয় শিখা। এর মধ্যস্থলে শ্বেতবর্ণের শঙ্কুটির (cone) চারপাশে নীলাভাযুক্ত শ্বেতবর্ণের শিখা দৃষ্টিগোচর হয়। এই শিখা কার্বনকে স্টীলের সাথে রাসায়নিকভাবে যুক্ত হতে সহায়তা করে। স্টীলের তৈরী পাইপে বাট জোড়া (Butt joint) দেওয়ার জন্য এই শিখা বিশেষ উপযোগী।
(খ) নিউট্রাল শিখা (Neutral Flame) :
যতটুকু পরিমাণ অক্সিজেন মিশ্রিত হলে অ্যাসিটিলিন পূর্ণভাবে জ্বলতে পারে, ঐ পরিমাণ অক্সিজেন ব্লো-পাইপে আসলে নিউট্রাল শিখার উদ্ভব হয়। চিত্রের মাঝের শিখাটি হচ্ছে নিউট্রাল শিখা। এই শিখাতে কারবুরাইজিং শিখার অনুরূপ নীলাভাযুক্ত শ্বেতবর্ণের শিখা থাকে না। এই শিখার অগ্রভাগ অপেক্ষাকৃত মোটা। এই শিখাতে তাপ উৎপন্ন হয় বেশী। তাই স্টীল, কাস্ট আয়রন, কপার ইত্যাদি ওয়েল্ডিং করতে এই জাতীয় শিখাই বেশী ব্যবহৃত হয়।
(গ) অক্সিডাইজিং শিখা (Oxidising Flame) :
যতটুকু অক্সিজেন অ্যাসিটিলিনের সাথে যুক্ত হলে অ্যাসিটিলিন জ্বলতে পারে, তার থেকে বেশী পরিমাণে অক্সিজেন ব্লো- পাইপের আসলে এই শিখার সৃষ্টি হয়। এই শিখার দৈর্ঘ্য কম এবং শীর্ষ অধিকতর সূক্ষ্ম হয়। ওয়েল্ডিং এর সময় এই শিখা দস্তাকে বাষ্পে পরিণত হতে বাধা দেয়। তাই পিতল জাতীয় ধাতু ওয়েল্ডিং করতে এই জাতীয় শিখা বিশেষ উপযোগী। নিউট্রাল শিখা থেকে এই শিখার তাপ কম।
ওয়েল্ডিং পদ্ধতি (Welding process) :
সাধারণত দুই পদ্ধতিতে ওয়েল্ডিং করা হয়ে থাকে। যেমন : (ক) ডানমুখী ওয়েল্ডিং (Rightward welding), (খ) বামমুখী ওয়েল্ডিং (Leftward welding)।
ডানমুখী ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে প্লেটের বামদিক হতে ওয়েল্ডিং শুরু হয় । এই পদ্ধতিতে ওয়েল্ডিং রড ব্লো পাইপের বাম দিকে অবস্থান করে । অর্থাৎ ব্রো-পাইপ ডান দিকে অগ্রসর
হতে থাকলে ওয়েল্ডিং রড তার পিছনে পিছনে গমন করে। এই পদ্ধতিতে ২ মি.মি. হতে ১৬.মি.মি. অর্থাৎ ৩/১৬” হতে ৫/৮” পুরু পাইপ ওয়েল্ডিং করা সুবিধাজনক। বামমুখী ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে ওয়েল্ডিং রড ব্লো-পাইপের বামদিকে রেখে প্লেটের ডানদিক থেকে ওয়েল্ডিং শুরু করতে হয়। ব্লো-পাইপ বামদিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ওয়েল্ডিং রড তার অগ্রে গমন করে থাকে। এই পদ্ধতিতেই বেশীরভাগ ওয়েল্ডিং করা হয়ে থাকে। এটি মেরামতের জন্য বেশী ভাল।
জোড়া বা সংযোগ (Joints) :
প্রধানত দুই প্রকারে প্লেট ওয়েল্ডিং করা হয়। যেমন :
(ক) বাট জয়েন্ট (Butt Joint), (খ) ফিলেট জয়েন্ট (Fillet Joint)।
বাট জয়েন্ট :
দুটি ধাতুখণ্ড বা প্লেটের প্রান্তকে মুখোমুখি এবং একই সমতলে রেখে সংযোগ দেওয়ার পদ্ধতিকে বাট জয়েন্ট বলে। ১৭.২৯ চিত্রে বাট জয়েন্ট দেখানো হল। জয়েন্ট তিন প্রকার- যথা : (ক) সরল বাট জয়েন্ট (Plain Butt Joint), (খ) সিঙ্গেল ‘ভী’ বাট জয়েন্ট (Single Vee Butt Joint), (গ) ডবল ‘ভী’ বাট জয়েন্ট (Double Vee Butt Joint)।
ফিলেট জয়েন্ট : (Fillet Joint) :
একটি ধাতুখণ্ড বা প্লেটের প্রান্তকে অপর একটি ধাতুখণ্ড বা প্লেটের সাথে বিভিন্ন তলে (Plane) রেখে জোড়া দেওয়ার পদ্ধতিকে ফিলেট জয়েন্ট বলে। ফিলেট জয়েন্ট তিন প্রকার : যেমন (ক) সিঙ্গেল ফিলেট ল্যাপ জয়েন্ট, (খ) ‘টী’ ফিলেট জয়েন্ট (Tee Fillet Joint), (গ) কর্নার ফিলেট জয়েন্ট (Corner Fillet Joint)।
রেজিসট্যান্স ওয়ে-ল্ডিং (Resistance Welding):
রেজিসট্যান্স ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তর করে ধাতুর পাতদ্বয় প্রায় গলন্ত অবস্থায় এনে চাপের সাহায্যে জোড়া দেওয়া হয়। রেজিসট্যান্স ওয়েল্ডিং তিন প্রকার। যথা : (ক) স্পট ওয়েল্ডিং, (খ) সীম ওয়েল্ডিং, (গ) বাট ও-য়েল্ডিং।
স্পট ওয়েল্ডিং (Spot welding) :
এই পদ্ধতিতে পর্যাবৃত্ত প্রবাহ (Alternating current) ব্যবহৃত হয়। ট্রান্সফর্মারের সাহায্যে ১০ থেকে ১৬ ভোল্ট বৈদ্যুতিক চাপে এবং ২৫০ থেকে ৫০০০ অ্যাম্পিয়ার কারেন্টের সাহায্যে কার্য সম্পাদন করে থাকে। ধাতুর পরুত্বের উপর অ্যাম্পিয়ার কম বা বেশী হওয়া নির্ভর করে। রেগুলেটরের সাহায্যে অ্যাম্পিয়ার নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
স্পট ও-য়েল্ডিং সার্কিটের বিভিন্ন অংশের নাম A-ট্রান্সফর্মার কোর (Transformer core), B-বিভিন্ন ট্যাপিং এবং প্রাইমারী কয়েল (Primary coil) C — সেকেন্ডারী কয়েল (Secondary coil)। E1, F2 = ইলেকট্রোড (Electrode) ; E1 =স্থির ইলেকট্রোড ; E2 = চলনশীল ইলেকট্রোড, P1, P2 = ও-য়েল্ডিং হবে এমন প্লেট। এই পদ্ধতিতে ৫ মি.মি. বা ৩/১৬”-এর কম বেধ এর শীট বা চাদর জোড়া দিতে সুবিধা হয়।
যে দুটি প্লেট বা পাত ও-য়েল্ডিং করা প্রয়োজন তা চিত্রানুসারে (স্পট ওয়ে-ল্ডিং সার্কিট) স্থির ইলেকট্রোডের উপর রাখতে হয়। অতঃপর সুইচ অন করতে হয় এবং প্যাডেলটি চাপ দিয়ে ওয়ে-ল্ডিং সম্পন্ন করতে হয়। প্যাডেলে চাপ দিলে চলনশীল ইলেকট্রোডটি নীচের দিকে নেমে আসে এবং উভয় ইলেকট্রোডের মধ্যে রক্ষিত প্লেটদ্বয় চাপ ও তাপের প্রভাবে বিন্দু বিন্দু (pof) আকারে ধাতু গলে উভয় ধাতুর মধ্যে জোড়া সৃষ্টি করে। উভয় ইলেকট্রোডের অগ্রভাগ বেশ সরু। এজন্য রিভিট না করে স্পষ্ট ওয়ে-ল্ডিং করাই শ্রেয়।
সীম ওয়েল্ডিং (Seam Welding) :
এই পদ্ধতির ওয়েল্ডিং স্পট ওয়েল্ডিং … । কেবল পার্থক্য হচ্ছে স্পষ্ট ও-ল্ডিং-এর ইলেকট্রোডদ্বয়ের অগ্রভাগ যে, সরু থাকে (tapered), সীম ও-য়েল্ডিং-এ তা থাকে না। এই পদ্ধতিতে ইলেকট্রোড দুটি গোল চাকতির মত (disc) যা চিত্রে দেখানো হয়েছে।
সুইচ অন করে সীট দুটি ইলেকট্রোডের উপর রেখে প্যাডেলের সাহায্যে চাপ দিয়ে উপরের ইলেকট্রোডকে শীটের সাথে মিলিয়ে (চাপ দিয়ে) ওয়েল্ডিং সম্পন্ন করা হয়। এই জাতীয় ওয়েল্ডিং এতই সুন্দর ও নিখুঁত হয় যে এটি শীটের উপর রেখার ন্যায় (সুবিন্যস্ত হয়) দেখায়। রেসিনের টিন, পেট্রোল ও ডিজেল ট্যাঙ্ক, বিভিন্ন ধরনের ড্রাম, দুধের পাত্র, ঘৃত ও তেলের পাত্র এবং রং জাতীয় বিভিন্ন আধার বা পট (pot) তৈরি করতে এই জাতীয় ওয়েল্ডিং ব্যবহৃত হয়।
ইলেকট্রিক আর্ক ওয়েল্ডিং (Electric Are Welding):
আর্ক ওয়েল্ডিং সমপ্রবাহ (Direct current, D.C) এবং পর্যাবৃত্ত প্রবাহের (Alternating Current A.C) সাহায্যে সম্পন্ন করা যায়। যেসব স্থানে এ.সি. সরবরাহ রয়েছে, সেখানে ট্রান্সফর্মার সেট ব্যবহার করা হয়। ডি.সি. সরবরাহ ক্ষেত্রে মোটর জেনারেটর সেট ব্যবহৃত হয়। যেসব স্থানে কোন প্রকার কারেন্ট সরবরাহ নেই সেখানে জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ স্থানে ট্রান্সফর্মার সেট ব্যবহার করা হয়। এতে সরবরাহ ভোল্ট বেশী থাকলেও (২২০/৪৪০ ভোল্ট) ওয়েল্ডিং-এর সময় ২৫ হতে ৩০ ভোল্ট ব্যবহার করা হয়। এই ভোল্টেই আর্ক উৎপন্ন করা সক্ষম। কিন্তু অ্যাম্পিয়ার বেশী লাগে।
আর্ক ও-য়েল্ডিং দুই প্রকার— যথা : (ক) ইলেকট্রোড দ্বারা শুধু আর্ক উৎপন্ন করা হয়, কিন্তু তা গলানো হয় না। এর সাহায্যে কোন ধাতু যোগ করা হয় না। যেমন— কার্বন বা টাংস্টেন ওয়েল্ডিং। (খ) ইলেকট্রোড দ্বারা আর্ক উৎপন্ন করা হয় এবং ঐ আর্কের সাহায্যে তা গলিয়ে জোড়ার স্থানে ধাতু যোগ করা হয়।
আর্ক ওয়েল্ডিং-এ দুই প্রকার ইলেকট্রোড ব্যবহার করা হয়। যথা : (ক) কার্বন ইলেকট্রোড এবং (খ) মেটাল বা ধাতু দ্বারা তৈরী ইলেকট্রোড। কার্বন ইলেকট্রোড দ্বারা ও-য়েল্ডিং করতে হলে সমপ্রবাহ দরকার হয়। এই সময় পজিটিভ টারমিনালে যে ধাতু ওয়েল্ডিং করতে হবে তার সাথে ভূ-সংযোগ (earthing) করতে হয়। এভাবে সংযোগ না দিলে কার্বনের কণা গলিত অংশে প্রবেশ করে ও-য়েল্ডিংকে হাল্কা ও ভঙ্গুর করে দেয়।
মেটাল ইলেকট্রোড (Metal Electrode) :
এই জাতীয় ইলেকট্রোড দ্বারা ওয়েল্ডিং করার জন্য সমপ্রবাহ এবং পর্যাবৃত্ত প্রবাহ ব্যবহার করা যায়। মেটাল ইলেকট্রোড মিশ্রিত ধাতু দ্বারা তৈরী। এর উপরিভাগে রাসায়নিক বস্তুর (Flux) আবরণ থাকে। এর দ্বারা ওয়েল্ডিং করার সময় লক্ষ্য রাখা দরকার, যে বস্তু ওয়েল্ডিং করতে হবে ইলেকট্রোড ঐ জাতীয় ধাতুর তৈরী হওয়া আবশ্যক। ইলেকট্রোডকে যে যন্ত্রের সাহায্যে ধরা হয় তাকে ইলেকট্রোড হোল্ডার বলে।
আরও দেখুনঃ
- ফিটিং কার্যক্রমের যন্ত্রপাতি | শীট মেটাল ফিটিং, ওয়েল্ডিং-ডেনটিং ও পেইন্টিং | অটোমোবিল ইঞ্জিনিয়ারিং
- এ পি আই আপেক্ষিক গুরুত্ব | ফুয়েলস এন্ড লুব্রিক্যান্টস | অটোমোবিল -ইঞ্জিনিয়ারিং
- তেল উত্তোলন | ফুয়েলস এন্ড লুব্রিক্যান্টস | অটোমোবিল -ইঞ্জিনিয়ারিং
- রোটারী ড্রিলিং পদ্ধতি | ফুয়েলস এন্ড লুব্রিক্যান্টস | অটোমোবিল- ইঞ্জিনিয়ারিং
- অপরিশোধিত তেল উত্তোলনের জন্য কূপ খনন ও উত্তোলন পদ্ধতি | ফুয়েলস এন্ড লুব্রিক্যান্টস | অটোমোবিল-ইঞ্জিনিয়ারিং
- মোটরগাড়ি শিল্প
1 thought on “একাধিক খণ্ডকে একত্র করতে ওয়েল্ডিং এর ব্যাবহার”